দিল্লির সেই ছাত্রীর লাশ গ্রহণ করলেন মনমোহন-সোনিয়া

ভারতের নয়াদিল্লিতে বাসে গণধর্ষণের শিকার সেই ছাত্রীর শেষকৃত্য যখন চলছিল, তখন পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছিল নতুন দিনের সূর্য। গতকাল রবিবার ভোরে সিঙ্গাপুর থেকে সোনালি কফিনবন্দি হয়ে একটি বিশেষ বিমানে নয়াদিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে পৌঁছে তাঁর মরদেহ।
এর ঘণ্টাখানেক পরই সম্পন্ন হয় শেষকৃত্য। এ সময় সেখানে পরিবারের সদস্য ও ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল ভোর সোয়া ৪টার দিকে ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে ২৩ বছর বয়সী ওই ছাত্রীর মরদেহ গ্রহণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। ওই সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিল হাজারো মানুষ। পরে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাঁর মরদেহ তাঁদের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে পশ্চিম দিল্লির দ্বারকা ২৪ সেক্টর এলাকার শবদাহ কেন্দ্রে নিয়ে শেষকৃত্য করা হয়। সেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশাধিকারের ওপরও আরোপ করা হয় বিধিনিষেধ।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা বিবিসি জানায়, সোনালি রঙের কফিনবন্দি মেয়েটির লাশ নিয়ে একটি গাড়িবহর বিমানবন্দর থেকে সোজা দিল্লির জানকপুরি এলাকার দিকে চলে যায়। ওই এলাকাতেই বসবাস করে মেয়েটির পরিবার। কিছু দিন আগেও পরিবারের সঙ্গে মেয়েটি সেখানে ছিলেন।
গণধর্ষণের পর ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে শনিবার ভোররাতে মারা যান ওই মেডিক্যাল ছাত্রী। এ সময় তাঁর পাশে ছিলেন মা-বাবা আর সিঙ্গাপুরে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত।
মেয়ের শেষকৃত্যের পরই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ছাত্রীর মা। তাঁকে দিল্লির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার বিচারের রায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পরিবার অনশন চালাবে বলে জানা গেছে। অন্য রাজ্যের মতোই ওই ছাত্রীর নিজ রাজ্য উত্তর প্রদেশের বাল্লিয়া জেলার মান্দোরা কালান গ্রামের মানুষও এখন শোকে মুহ্যমান। গ্রামপ্রধান শিবমন্দির সিং জানিয়েছেন, মেয়েটির আত্মার শান্তির জন্য ইতিমধ্যে একটি প্রার্থনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মান্দোরবাসী চায়, ধর্ষকদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়।
এদিকে সহিংস বিক্ষোভের আশঙ্কায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে নয়াদিল্লিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোয়। রাস্তায় মোতায়েন করা হয়েছে দাঙ্গা পুলিশ। অনেক সড়ক, বিপণিবিতান ও মেট্রো রেলস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে পাঁচজনের বেশি একত্রে জড়ো হওয়ার ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। জনগণকে শান্ত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।
গত ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সিনেমা দেখে ফেরার পথে বাসে গণধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধুকেও মারধর করে ধর্ষকরা। গণধর্ষণের পর ব্যাপক মারধর করে বন্ধুসহ মেয়েটিকে ধর্ষকরা চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁদের ভর্তি করা হয় দিল্লির সফদারজঙ্গ হাসপাতালে। তিনটি বড় অস্ত্রোপচারের পরও ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠায় গত ২৭ ডিসেম্বর মেয়েটিকে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে।
দিল্লি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়েও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দুবার জবানবন্দি দিয়েছিল মেয়েটি। ধর্ষণের ওই ঘটনা এবং ধর্ষণকারীদের বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়ে যান তিনি। ধর্ষণকারীদের যে বিচার চান, তাও ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিলেন ওই তরুণী।
ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
ধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো ভারত। দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যে রাস্তায় নামে বিক্ষোভকারীরা। নারীর নিরাপত্তা বিধানে সরকারের আরো কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার দাবি জানায় তারা। এই নৃশংস ঘটনা প্রবল নাড়া দিয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে। শনিবার মেয়েটির মৃত্যুর খবরে আরো তীব্র প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে দেশের মানুষ। ভারতজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে অগণিত মানুষ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শনিবার রাতে ইন্ডিয়া গেটসহ বিভিন্ন রাজ্যে প্রদীপ জ্বালায় ভারতবাসী। সেই মোমের শিখায় মিশে ছিল ক্ষোভ, ধর্ষকদের প্রতি ঘৃণা।
মোমবাতি হাতে ইন্ডিয়া গেটের কাছে দাঁড়ানো এক তরুণীর অন্য হাতে দেখা যায় একটি পোস্টার, যাতে লেখা- 'সে মরেনি, শুধু চলে গেছে সেই দেশে, যেখানে ধর্ষণ বলে কিছু নেই।'
মেয়েটির এই মৃত্যুকে 'বীরের মৃত্যু' বলে অভিহিত করেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ধর্ষকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অঙ্গীকারও তিনি ব্যক্ত করেছেন। ক্ষমতাসীন জোট সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার।
সোনিয়া বলেন, 'আমাদের দেশের সব নারীকে সুরক্ষা দিতে এবং তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের পূর্ণ শক্তি এবং আইন ও প্রশাসনের শক্তি দিয়ে লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত আমাদের। ওই তরুণীর লড়াই বৃথা যাবে না।'

No comments

Powered by Blogger.