চরাচর-মতিঝিলের প্রেসপাড়া by এস কবীর

সভ্যতার একটা নয়া মোড় মুদ্রণ প্রযুক্তির আবিষ্কার। আমাদের যা কিছু বলার বা তথ্য সরবরাহ থেকে যেকোনো সংবাদ পরিবেশনের বিবর্তন ঘটে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর। সকালের খবরের কাগজ বা গল্প-উপন্যাসের বই হাতে বসে অনেকে হয়তো জানতেই পারে না, এর পেছনে কতখানি পরিশ্রম জড়িত।
অনেকে জানেই না এটা কিভাবে বই হয়ে উঠেছে। এর পেছনের কাহিনীই অহরাত্র ঘটে চলেছে ছাপাখানায়।
আমাদের দেশে রয়েছে কয়েক হাজার মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বেশির ভাগেরই অবস্থান ঢাকা শহরে। এককালে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার লেন, বাংলাবাজার আর আশপাশের বেশ কিছু এলাকাজুড়ে ছিল ছাপাখানার রাজত্ব। গত ২৪ থেকে ২৫ বছর ধরে মতিঝিলের আরামবাগ, ফকিরাপুল আর পল্টন এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল প্রেসপাড়া। আরামবাগ আর ফকিরাপুল ছোট্ট দুটি আবাসিক এলাকা। একটা আরেকটার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে কয়েক জায়গায় বোঝাই যায় না, কোনটা আরামবাগ আর কোনটা ফকিরাপুল। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা লাগোয়া বলে এ এলাকার গুরুত্বই আলাদা। অনেক মানুষ, বিশেষ করে চাকরিজীবীরা এসব জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন। দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকার চাহিদা মানুষের এক নম্বরে। এভাবে এলাকা দুটি ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে দাপ্তরিক কাজকর্মে ব্যবহৃত কাগজপত্র সরবরাহকারীদেরও পছন্দের জায়গা এটা। মতিঝিল ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা কাছে হওয়ায় ছাপাখানাগুলো বসেছে এসব এলাকায়ই। ফলে আরামবাগ আর ফকিরাপুলের অলিগলি, তস্যগলিতেও এখন প্রেস আর প্রেস। সেই সঙ্গে এই প্রেস ব্যবসা ঘিরে গড়ে উঠেছে বাঁধাই কারখানা, কাগজের দোকান, কালির দোকান। আরো আছে কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান, প্লেট বানানোর প্রতিষ্ঠানসহ অনেক কিছু। মুদ্রণের অনেক মাধ্যম আছে। আগে যেমন ছিল লেটার প্রেস। সিসার অক্ষর সাজিয়ে লাইন, আর সেভাবেই পুরো বই। সেগুলো আজ হয়ে গেছে ইতিহাস। এখন আধুনিক পদ্ধতি হচ্ছে অফসেট। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুদ্রণ পদ্ধতি আছে। চকচকে রাংতার মতো ছাপার জন্য ফয়েল প্রিন্ট। আবার কাপড় বা অন্য দ্রব্যের ওপর ছাপার জন্য আছে স্ক্রিন প্রিন্ট। এর মধ্যে হস্তচালিত কিছু মেশিন এখনো আছে, তবে বেশির ভাগই হয়ে গেছে আধুনিক মেশিন। ছোট্ট একটি প্রেসের মালিক জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কিছুদিন আগে তিনি একটা প্রেসে চাকরি করতেন। এখন তাঁর বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে ছোট্ট একটি মেশিন কিনে নিজেই চালান। এতে তাঁর বেতন লাগে না, যা আয় হয় সবটাই তাঁর নিজের থাকে।
যত্রতত্র মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় অন্য রকম সমস্যাও দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। মুদ্রণ সমিতি বা বিভিন্ন প্রেসের মালিকরা জানান, তাঁরা বারবার সরকারের কাছে আবেদন করছেন শহরের কাছে কোথাও একটা মুদ্রণপল্লী করে দেওয়ার জন্য, যেখানে পরিকল্পিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারবে। এ রকম একটা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এর সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষের জীবিকা। সেই সঙ্গে ছাপাখানাকে ঘিরে রয়েছে অনেক রকমের ব্যবসা। সেখানেও জড়িত হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজি। আবার স্বাস্থ্যগত পরিবেশ, শিল্প বিকাশের প্রকৃত উপায় সব কিছু মিলিয়ে এটাকে নিয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে জানালেন এর সঙ্গে জড়িতরা।
এস কবীর

No comments

Powered by Blogger.