চালচিত্র-সাপের ঝাঁপি, না গণতন্ত্রের ঝাঁপি by শুভ রহমান

কতভাবেই না বলা যায়! বিদায়ী বছরটা ছিল ঘুষ-দুর্নীতি, দুর্ঘটনার বছর। হত্যা, সন্ত্রাস, গুম ও ভয়াবহ সব অপরাধের বছর। তত্ত্বাবধায়ক, না দলীয় সরকার, তা নিয়ে কালক্ষেপণের বছর। জিনিসপত্রের দাম কিছুতেই নাগালে না আনতে পারার বছর।
যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে অথবা না করতে পারার বছর। এই রকম আলাদা আলাদাভাবে প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, প্রত্যাশা ও হতাশার একটা ঢালাও হিসাব কষে গেল বছরের গায়ে সিলছাপ্পড় মেরে দিলে তেমন আপত্তি করার কিছু থাকবে না। একই সঙ্গে সেটা খুব সঠিকও হবে না। গ্লাসটা অর্ধেক খালি বললে অর্ধেকটা ভর্তি, এটাও কার্যত মেনে নেওয়াই হয়। তেমনি অতিক্রান্ত ২০১২ সালকে ঢালাওভাবে ব্যর্থতা কিংবা সাফল্যের বছর বলে চিহ্নিত করলেও সেটা তেমন সঠিক বা বেঠিক হবে না।
বাস্তবে অতিক্রান্ত বছরের সাফল্য বা ব্যর্থতার চুলচেরা হিসাব-নিকাশ কষে একটা গ্রহণযোগ্য চূড়ান্ত রায় দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রথামাফিক সাফল্য বা ব্যর্থতার খতিয়ান বস্তুত এবারে সম্ভব নয়। তার পরও সামনে দৃঢ়ভাবে পা ফেলার জন্য সে রকম প্রথামাফিক হিসাব-নিকাশের প্রয়োজনটাকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যাবে না।
মোটা দাগে যে কয়টি বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে লেজেগোবরে হতে হয়েছে, সরকারকে জনপ্রিয়তা হারানোর অবস্থানে যেতে হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে: ১. পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন, ২. তাজরীন গার্মেন্টে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের জীবন্ত পুড়ে মরা, ৩. সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, ৪. নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎকে উন্মত্ত সহিংসতায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা, ৫. রামু-উখিয়া-পটিয়ায় উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তির তাণ্ডবে বৌদ্ধ পল্লী, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থরাজি, বৌদ্ধ মন্দির, বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া, ৬. ইলিয়াস আলীসহ প্রতিপক্ষের কয়েকজনের গুম হওয়া, ৭. কোনোক্রমেই নিত্যপণ্যের দাম ক্রেতাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না আনতে পারা, ৮. সড়ক দুর্ঘটনায় বিশিষ্ট সাংবাদিক তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের বেদনাদায়ক অকালমৃত্যু এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের আমলে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো রকম উন্নতি না হওয়া ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল এবং বেহাল সড়কে জনদুর্ভোগ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া। এগুলো মোটা দাগের ব্যর্থতা। এর বাইরেও অনেক ব্যর্থতা রয়েছে, যেগুলো সত্যিকার গণতান্ত্রিক কোনো সরকারের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে না।
পাশাপাশি, মোটাদাগে মহাজোট সরকারের সাফল্যের বিষয়গুলো হচ্ছে : ১. গত চার বছরই কৃষিতে উৎপাদন ক্রমবর্ধমান থাকা এবং কৃষকের কাছে সার, কীটনাশক, বীজ প্রভৃতি কৃষি উপকরণ ও যথাসময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষকের ক্ষোভ প্রশমন, ২. শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বছরের শুরুতেই বিনা মূল্যে বই সরবরাহ নিশ্চিত করা, ৩. কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্র বাপেঙ্রে উদ্যোগে চিহ্নিত করা ও দেশি প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনা দেখা দেওয়া, ৪. পাটের জন্মরহস্য উদ্ঘাটনসহ একাধিক চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাফল্য অর্জন এবং ৫. জাহাজশিল্পের বিকাশ ও জাহাজ রপ্তানির সূচনা। এসবের বাইরে বেশ কিছু আংশিক সাফল্যও রয়েছে, যেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হলে জাতির অগ্রযাত্রা মসৃণ হবে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে মহাজোটের উলি্লখিত সাফল্যগুলো সদাতৎপর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার ১৮ দলীয় জোটসঙ্গী মৌলবাদী ও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল বা গ্রুপগুলোর তীব্র বিরোধিতায় নেতিবাচক রাজনীতির ঘনকৃষ্ণ মেঘের আড়ালেই চাপা পড়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের সীমাহীন অথর্বতার দরুন নিজেদের সাফল্যকেও দৃঢ়ভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রেও সরকারের যতটা দৃঢ়ভাবে ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে সোচ্চার হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল, মহাজোট সরকার তা হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথাবার্তায় যত বুদ্ধিমত্তার পরিচয়দানে চমক সৃষ্টিতে পারঙ্গম, দেশবাসীর বিভ্রান্তি দূর করতে গোটা বিচার প্রক্রিয়ার বিশ্বস্বীকৃত রীতিনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তত দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। প্রতিপক্ষের প্রায় সব রাজনৈতিক কর্মসূচিকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘি্নত করার প্রয়াস বলে ঢালাও মন্তব্য করে তিনি বরং বিষয়টাকে খানিকটা কৌতুকপ্রদই করে তুলেছেন। মৌলবাদী হিংস্র বিষধর দলগুলোকে মাথায় চাপিয়ে বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করতে নেমেছেন- এমন মন্তব্য করে বিষয়টাকে যতটা সরল করার প্রয়াস পেয়েছেন, বাস্তবে তা হচ্ছে না। বিরোধী পক্ষ যে জবাব দিয়েছে, বিরোধী নেতার মাথায় সাপের নয়, গণতন্ত্রের ঝাঁপি, সাধারণের কাছে সেটাই বরং অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক রীতিপদ্ধতি মেনেই করবে বলে যে বক্তব্য বিরোধী দল দিচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে সে ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা তুলে ধরাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত হতো। বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া তিন টার্ম ক্ষমতায় থেকেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেননি, করার কোনো রকম উদ্যোগই নেননি, আজ তাঁর মুখে সে বিচার করার প্রতিশ্রুতি আদৌ মানায় না এবং যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় শরিক করে কখনো যে তা সম্ভবই হতে পারে না- এটাই সাধারণ মানুষকে প্রতিপক্ষের বক্তব্যের অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ করার জন্য যথেষ্ট। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল হয়েছিল এবং এর পরও বসনিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া ও চিলির যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান ও ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে, তার প্রামাণ্য দলিল জনসমক্ষে তুলে ধরাই জনগণের কাছে অধিকতর 'কনভিনসিং' হতো। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের যেসব সহযোগী বিদেশে লবিং ও কোটি কোটি ডলার অর্থসংগ্রহের তৎপরতা চালাচ্ছে বলে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেসবেরও প্রামাণ্য দলিল ত্বরিত দেশের অভ্যন্তরে জনগণের মধ্যে ছড়ানো ছিল অত্যাবশ্যকীয়। সেসব পদক্ষেপ ছাড়া শুধু প্রতিপক্ষের হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি যুদ্ধাপরাধের বিচার ভণ্ডুল করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে বললে জনগণের বিভ্রান্তি দূর হবে না। ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগেও দেশবাসী কিন্তু 'কনভিন্সড্' হয়নি যে বিরোধী প্রচারমাধ্যম বিচার বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্যেই নিজামুল হকের বক্তব্য প্রচার করেছে। মোটের ওপর, বিরোধী পক্ষ যে বিচার ভণ্ডুল করার অসৎ উদ্দেশ্যেই সংবিধানবহির্ভূত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটিতেও অনড় রয়েছে, সংসদকে অকার্যকর করে রাখছে- এসব অভিযোগ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করার মতো আরো বাস্তব তথ্য-উপাত্তও তুলে ধরা দরকার ছিল। সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে, বিরোধী নেতাকে সংলাপে বসে সমঝোতায় আসার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মহাজোট সরকারকেই এগিয়ে এসে বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া। সে ব্যাপারে অযথা কালক্ষেপণ করে জনমনে সংশয় ও বিভ্রান্তি গভীর ও জটিল হতে দেওয়া গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারকে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহই হতে হবে যে তাদের মেয়াদের শেষ বছরেও সংলাপ ও সমঝোতা নিশ্চিত না করতে পারলে তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করে দোষীদের শাস্তিবিধান কিছুতেই সম্ভব হবে না।
মহাজোট সরকারের অতিক্রান্ত চার বছর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঘটনাবহুল হলেও সবচেয়ে নির্ধারক বছর হবে সামনের ২০১৩ সালটিই। আজ মেয়াদের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, নতুন বছর অভ্রান্তভাবে বিরোধী পক্ষকে সমঝোতায় আসতে বাধ্য করতে না পারলে, অনেক বিশেষজ্ঞের মতেই সামনে এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী ও সংঘাতময় বছর অপেক্ষা করছে। বিরোধী নেতার মাথায় সাপের ঝাঁপি, না গণতন্ত্রের ঝাঁপি, তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়ে যাবে আসন্ন শেষ বছরেই। ঝাঁপি খুলে হিংস্র বিষধর, না গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি, কী বেরোয়- সারা দেশ ও বিশ্বের কাছেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
দেশবাসীকে সে ধন্দে না রেখে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির কর্তব্যই হবে আর কালবিলম্ব না করে এ দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সর্বতোভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জনগ্রাহ্য ও শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী হয়ে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারা হবে মহাজোটের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। সব 'ইগো' ও সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে মহাজোট সরকারের আগ বাড়িয়ে সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করাই শ্রেয়।
অতীতে লগি-বৈঠার দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে ছোবল হেনেছিল এক বিষধরই। দেশবাসীর সচেতনতায় সে বিপদ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। আজ গণতন্ত্রের বিকাশমান পর্যায়ে এসে আমরা কি তার চেয়েও ভয়ংকর বিষধরকে ডেকে আনব গণতন্ত্রকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সংহার করতে দেওয়ার চরম মূর্খতা ও মূঢ়তায়?
২৯. ১২. ২০১২

No comments

Powered by Blogger.