স্মরণ- সাম্যবাদীদের ধ্রুবতারা

ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা আর জামালপুরের পাঁচটি থানার ৮০০ বর্গমাইল এলাকায় সামন্তবাদের প্রবল প্রতিপত্তি। সেখানে নগদ টাকার পরিবর্তে ধান কাড়ারী খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এ ব্যবস্থার নাম টংক। সাধারণভাবে জমির ওপর খাজনা ছিল একরপ্রতি, স্তর ভেদে ৫ থেকে ৭ টাকা।
আর টংক প্রথায় কৃষককে একরপ্রতি দিতে হতো সাত থেকে ১৫ মণ ধান। জমিতে ফসল না হলেও চাষিকে পরবর্তীকালে এই টংক পরিশোধ করতে হতো। কখনো কখনো অন্য জমির ফসল দিয়ে তা শোধ করতে বাধ্য করা হতো। টংক প্রথায় জমির ওপর চাষির কোনো স্বত্বও ছিল না। যেকোনো সময় জমি থেকে চাষিকে উচ্ছেদ করা যেত। এ টংক জমিদারির মালিক ছিলেন মণি সিংহের মাতৃকুল।
মণি সিংহ নিজের পরিবারের স্বার্থ উপেক্ষা করে ১৯৩৭ সাল থেকে এ নিষ্ঠুর শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি হাজং, মান্দা, গারো, দরিদ্র মুসলমান-হিন্দু চাষিদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। জমিদার ও সরকার উভয়ে এ আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। মণি সিংহের নেতৃত্বে চাষিরাও সংগঠিত হন। তাঁরাও প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যান। আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে ১৯৪০ সালে সরকার সার্ভে করে টংকর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁরা ঘোষণা করেন, টংক প্রথার বিলোপ ছাড়া অন্য কিছু মানবেন না। সাধারণ আইন অনুযায়ী ন্যায্যভাবে নগদ টাকায় খাজনা নির্ধারণ করতে হবে।
১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় কিষান সভার কেন্দ্রীয় সম্মেলন। মণি সিংহ ছিলেন ওই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। সভাপতিত্ব করেন কমরেড মুজাফফর আহম্মদ। বিশাল এ সম্মেলনেও টংক প্রথা বিলোপের পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী লড়াই আরও তীব্র হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ১২ বছর লড়াইয়ের পর ১৯৫০ সালে সরকার টংক প্রথা রহিত করে টাকায় খাজনা নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ এ লড়াইয়ে নারী-পুরুষ-শিশুসহ ৬০ জন সংগ্রামী শহীদ হন। মণি সিংহের নিজের বসতভিটাও ধূলিসাৎ করে সেখানে হালচাষ করা হয়। তাঁর সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলাম করে সরকার বিক্রি করে দেয়।
মণি সিংহ তাঁর কৈশোর থেকে স্বপ্ন দেখেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের। শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনতার জাগরণ সৃষ্টি করেই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হয়েছেন। মেটিয়া বুরুজে স্কুলছাত্র অবস্থা থেকে ১৯৯০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তাঁর সাম্যবাদী আদর্শে অটুট ছিলেন।
১৯০০ সালে মণি সিংহের জন্ম। তাঁর যখন মাত্র আড়াই বছর বয়স, তখন তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা দুর্গাপুরে পিত্রালয়ে চলে আসেন। দুর্গাপুরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য আবার কলকাতায় যান। শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিপ্লবী অনুশীলন দলে এবং পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
মণি সিংহের রাজনৈতিক জীবন খুবই বর্ণাঢ্য ও গৌরবমণ্ডিত। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তাসমন্বিত একাগ্রতা সব বিপ্লবী ও কমিউনিস্টের কাছে চির অনুপ্রেরণার উৎস। আত্মগোপনে থেকেও ৪৮, ৫২, ৬২, ৬৪ ও ৬৯—সব আন্দোলনে তিনি সফল ও গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে জনতা রাজশাহী জেল ভেঙে তাঁকে মুক্ত করে। জেল থেকে বের হয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের তিনি একজন উপদেষ্টা ছিলেন।
অনতিক্রম্য সংগ্রামী মণি সিংহ সব কমিউনিস্ট প্রগতিশীলের ধ্রুবতারা। সাম্যবাদে বিশ্বাস নিয়েই তিনি ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দিলওয়ার হোসেন, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.