নারীর প্রতি সহিংসতা- কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন? by সোনিয়া আশরাফী

বিশ্বমানবতা আজ কাঁদছে গুমরে গুমরে। কাঁদছে রোষে উন্মাত্তাল হয়ে একটি ২৩ বছর বয়সী মেয়ের জন্য। আর্তনাদ উঠছে চারদিকে এই ভঙ্গুর, নষ্ট, পচা, ঘুণে ধরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে।
এ কোন সভ্যতা? এ কোন সভ্য সমাজ? এ কোন সভ্য দেশ, যেখানে এক তরুণী রাত ১০টায় বন্ধুর সঙ্গে বাসে উঠে বাড়ি ফেরার পথে পৈশাচিক লীলার বলি হন? তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন করা হয়, তাঁর শরীরকে হায়েনার খাদ্যে পরিণত করা হয়। বাদ যাননি তরুণীর বন্ধুটিও। দুজনকে রড দিয়ে বেদম প্রহার করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মৃত্যুর কোলে সমর্পিত হন এই তরুণী, ২৯ ডিসেম্বর।
এ তো গেল পাশের দেশ ভারতের কথা। ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশে খোদ রাজধানীর দক্ষিণখানের ব্র্যাক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২৭ বছর বয়সী চিকিৎসক সাজিয়া আরেফিন খুন হন ক্লিনিকের ভেতর কর্তব্যরত অবস্থায়। সাজিয়া ছিলেন দক্ষিণখানের নোয়াপাড়া আমতলায় ব্র্যাক পরিচালিত ব্র্যাক ক্লিনিকের খণ্ডকালীন চিকিৎসক। পুলিশের ভাষ্যমতে, সাজিয়াকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত এবং গলায় কালো দাগের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। আর এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। পত্রিকা মারফত আরও জানা যায়, চিকিৎসক সাজিয়াকে খারাপ প্রস্তাব দেয় নিরাপত্তাকর্মী। আর তাতে রাজি না হওয়ায় বেধড়ক মারধর করে গুরুতর জখমের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।
এরই ২০ দিন আগে ৯ অক্টোবর নারীশিক্ষা আন্দোলনের অকুতোভয় কর্মী ১৪ বছরের কিশোরী মালালা ইউসুফজাই পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় গুলিবিদ্ধ হয়। বিদ্যালয় থেকে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে তালেবানরা এ ঘটনা ঘটায়। যদি প্রশ্ন করা হয়, কী তার অপরাধ? উত্তর: এই কিশোরী নারীশিক্ষার কথা বলেছে। নারী স্বাধীনতার কথা বলেছে।
ওপরের ঘটনাগুলো খুবই বিচ্ছিন্ন। দেশ, কাল, সময়—সবই আলাদা। শুধু একটি জায়গাতেই মিল; তা হচ্ছে, সহিংসতার শিকার নারী; কেবল দেশ, কাল, পাত্রভেদে। এখানে মনে করার কোনো কারণ নেই যে তিনটি দেশে, শুধু এই তিন মাসে এই তিনটি ঘটনাই ঘটেছে। ঘটছে প্রতিদিন, প্রতিবেলায়, প্রতি রাতে। কিছু আমরা জানতে পারছি পত্রপত্রিকা থেকে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু প্রত্যন্ত বাংলাদেশে, প্রত্যন্ত ভারতে বা প্রত্যন্ত পাকিস্তানে নারী জনগোষ্ঠীর কথা রয়ে যাচ্ছে সেই বুকের ভেতরেই জগদ্দল পাথরের মতো। কে তার খোঁজ রাখে?
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন, পত্রপত্রিকা মারফত জানা যায়, নারীর এই সহিংসতার চালচিত্র প্রতিবছরই বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হিসেবে কত না আধুনিক দাবি করি নিজেদের। দাবি করি, আজকের ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ’। এই কি শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ, যেখানে আমরা আমাদের আদিমতম পশুবৃত্তিকেই জলাঞ্জলি দিতে পারলাম না? আইপ্যাড, থ্রিজি মোবাইল, আধুনিক যন্ত্রপাতি, কলাকৌশল আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা আজ অমরত্ব দাবি করছি। কিন্তু এই নীল বিষে ভরা অমরত্ব দিয়ে কী করব আমরা? এই তিন নারীর মধ্যে দুজন সহিংসতার শিকারে মৃত্যুবরণ করেন আর একজন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি: কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটে? উত্তর কি এ রকম? ১. তাঁরা নারীশিক্ষার পথে ছিলেন? ২. তাঁরা নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন? একজন চিকিৎসক হিসেবে পুরুষ চিকিৎসক যে কর্তব্য পালন করেন, নারী হয়ে সেই কর্তব্য পালনে সাড়া দিয়েছিলেন বলে? ৩. নাকি নারী বলে তাঁর পছন্দ, জাত, ভেদ কিছু নেই? ৪. নাকি নারী মাত্রই তিনি অবলা? ৫) অথবা নারী মানেই রাত ১০টায় ‘তুমি’ ফুর্তির সামগ্রী তা তোমার অভিভাবক, বন্ধু অথবা রক্ষাকর্তা থাকুন বা না-ই থাকুন? এই সভ্যতা আর সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে নারীর প্রতি সহিংসতাকে চিরতরে নির্মূল করতে হবে। সেই সময় এখনই। আর দেরি নয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। পরিবারে কেন আমরা শুধু মেয়ে বা নারীকে বলব সাবধানে থাকতে? নারীকে কী চোখে দেখবে—কেন পরিবার থেকে পুরুষকে সে শিক্ষা দেওয়া হয় না? কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ছেলে শিক্ষার্থীকে নারীর প্রতি কী দৃষ্টিভঙ্গি হবে, তা বলা হয় না? কেন রাষ্ট্র নারীর প্রতি সহিংস ঘটনাকে নিছক এক ঘটনা মনে করে?
এই কেন-র উত্তর আমরা চাই। আর দুই দিন পর যে নতুন সূর্য উঠবে নতুন এক দিনের, সেই নতুন দিনে আমরা যাঁরা বিশ্বসভ্যতার অংশ, তাঁদের যেন আর এই লালসার দাবদাহে পুড়ে ছাই না হয়ে যেতে হয়। বলতে না হয়—
‘এ কোন মৃত্যু!
কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন?
শিয়রে যাদের ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু
হিমালয় থেকে সুন্দরবন কেঁপে কেঁপে ওঠে...’

নয়াদিল্লি থেকে
সোনিয়া আশরাফী: রিসার্চ ফেলো, জহওরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি।

No comments

Powered by Blogger.