রাজনীতি হোক মানুষের জন্য

যে নিষ্ঠুরতা তাঁর ওপর চেপে বসেছিল, তাকে হটিয়ে বহুদূরের না-ফেরার দেশে চলে গেছেন তরুণীটি। রাজধানী নয়াদিল্লিতে বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টার শোয়ে সিনেমা দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। তাঁর একমাত্র অপরাধ, আধুনিক ভারতে নিজেকে নিরাপদ ভেবেছিলেন তিনি।
মেয়েটি আজ ভারতে ঘরে-বাইরে নারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। দিল্লির হাসপাতালের বিছানায় যখন তিনি গুমরে গুমরে মরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন প্রতিবাদকারীদের কাছে বিক্ষোভের বিদ্যুতের সঞ্চালক হয়ে ওঠেন। তাঁর ওপর যে নির্যাতন চলেছিল শুধু তার প্রতিবাদেই নয়, ওই বিক্ষোভ হয় রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিন নারীদের যেসব নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় তার প্রতিবাদেও।
ভারতের রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, ওই ছাত্রীর ওপর যে নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেছে, সেটা তো দেশের একমাত্র ঘটনা নয়। এ চিত্র প্রতিদিনের, সর্বত্র। যারা দিনে খবরের কাগজে অন্তত একবার চোখ বুলায়, তাদের চোখে পড়ে বহু নারী নির্যাতনের ফিরিস্তি। গণধর্ষণও এখন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিল্লিসহ সারা দেশে আজ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি দুর্ব্যবহার, আঘাত, উত্ত্যক্ত করা, হয়রানি, কটূক্তি, ধর্ষণের প্রতিবাদে আজ নারীদের মা-বাবা, ভাই-বোন-বন্ধু সবাই একযোগে সরকারকে বলছেন, 'আমাদের বেদনার কথা শুনুন।'
নারী নির্যাতনের একটি হিসাব থেকে দেখা যায়, ভারতে ২০১১ সালে ২৪ হাজার নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পায়। এতে দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় ধর্ষণ বেড়েছে ৯.২ শতাংশ। আর নির্যাতিতের অর্ধেকেরও বেশির (৫৪.৭ শতাংশ) বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের কোনো দেশেই এমন কোনো পুলিশ বাহিনী নেই, যারা এসব অপরাধ পুরোপুরি ঠেকাতে পারছে। তাদের মতে, এর পরও সরকার ও পুলিশ যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ত্বরিতগতিতে একটা ব্যবস্থা নেওয়া। ঠিক সময়ে তথ্য দেওয়া ও দোষীদের বিচারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সরকার কোনো দখলদার সরকার নয়। তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য। কোনো পরিস্থিতিতেই জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক সরকারও জনগণের কথা শোনার পরিবর্তে প্রতিবাদকারীদের ওপর সহিংস আচরণ করে।
সমাজসচেতন ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার ইস্কালাসের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেন, "যুদ্ধে সবার আগে 'সত্য' আহত হয়।" তাঁদের মতে, ভারত তো এখন কারো সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় নেই। এমনকি এই প্রতিবাদ কোনো বিপ্লবও নয়। শুধু কিছু উদ্বিগ্ন মানুষ তাদের নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তাদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা, জলকামান, টিয়ার শেল ছোড়ার ঘটনা অনভিপ্রেত। এর ওপর সরকার মিথ্যাচারেরও আশ্রয় নিচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন তাঁরা। কয়েক দিন ধরে চলা দিল্লির বিক্ষোভ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের কাদা ছোড়াছুড়ি থেকেই বিষয়টির আঁচ পাওয়া যায়। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শিলা দীক্ষিত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্দে ও পুলিশ কমিশনার নিরাজ কুমারের বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তাঁদের কারোরই সরকারি ভাষ্যে আস্থা নেই।
এখন সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মেয়েটির জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠায় সরকার। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, তাঁকে বিদেশে নেওয়ার বিষয়টি যতটা না উন্নত চিকিৎসার জন্য, এর চেয়ে বেশি কাজ করেছে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য। তাই দাবি উঠেছে, রাজনীতির জন্য রাজনীতি নয়_মানুষের জন্য, মানুষের নিরাপত্তার জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতির চর্চা হোক।

No comments

Powered by Blogger.