স্মরণ-মুক্তিযুদ্ধের এক মহানায়ক by আরাফাত শাহরিয়ার

মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন ছেলে বড় হয়ে বাঙালি জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে। ১৯৭১ সালে মুক্তির সংগ্রামে এই ছেলেটিই মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। সেই ছেলেটিই মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী।


বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান চাকরি করতেন তৎকালীন আসামের সুনামগঞ্জ সদর মহকুমায়। বাবার ছিল বদলির চাকরি। কিছুদিন পর সুনামগঞ্জ থেকে চলে যেতে হয় গৌহাটিতে। সেখানেই ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু। ১৯২৩ সালে ভর্তি হন 'কটনস্ স্কুল অব আসাম'-এ। স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হন তিনি। আবারও বাবার বদলি। পরিবারের সবার সঙ্গে যেতে হলো সিলেটে। ১৯৩২ সালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো সিলেট গভর্মেন্ট পাইলট হাই স্কুলে। অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলেন। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে তিনি প্রথম হলে ব্রিটিশ সরকার তাকে পুরস্কৃত করে। পরে তিনি পড়াশোনা করেছেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ওসমানী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে দেখা যায় ওসমানীই হচ্ছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর! ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে লড়তে হয় ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে। ভারত বিভাগের আগেই (১৯৪৭) তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৪৭ সালে একই পদ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে নিযুক্ত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফার্স্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন। ১৯৬৭ সালে অবসর নেন ওসমানী। পেশাগত কারণে বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি তাঁর।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায়ই ছিলেন ওসমানী। ওই রাতে তাঁকে হত্যার চেষ্টায় হন্যে হয়ে খোঁজে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কমান্ডো। কিন্তু ভাগ্যগুণে বেঁচে যান তিনি। চার দিন আত্মগোপনে থেকে নদীপথে পালিয়ে গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যুদ্ধরত ব্যাটালিয়নদের সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। এম এ জি ওসমানীকে করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই তিনি বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন। সাবেক ইপিআরের বাঙালি সদস্য, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে গঠন করেন গেরিলা বাহিনী। ৩ ডিসেম্বর থেকে ওসমানীর বাহিনীর সঙ্গে ভারতের সৈন্যরাও যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
শেষ জীবনে দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতা অটুট ছিল তাঁর। কিন্তু তত দিনে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। ১৯৭৬ সালে তিনি 'জাতীয় জনতা পার্টি' গঠন করে জনগণকে ঐক্যের ডাক দেন। কিন্তু সেই ডাকে খুব একটা সাড়া পাননি।
বীর সৈনিক বিভিন্ন যুদ্ধে বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও শেষতক চিরন্তন মৃত্যুকে জয় করতে পারেননি। শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হলে ১৯৮৪ সালে তাঁকে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে। মুক্তিযুদ্ধের এই সর্বাধিনায়কের স্মরণে ঢাকায় গড়ে উঠেছে 'ওসমানী উদ্যান' ও 'ওসমানী মেমোরিয়াল হল'। এ ছাড়া তাঁর সিলেটের বাসভবনকে পরিণত করা হয়েছে জাদুঘরে। সিলেট শহরে তাঁর নামানুসারে নির্মাণ করা হয়েছে একটি হাসপাতালও। মৃত্যুদিনে এই মহানায়ককে আমরা স্মরণ করছি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
আরাফাত শাহরিয়ার

No comments

Powered by Blogger.