সাকার উপস্থিতিতে পাক আর্মিরা আমার পাঁচ স্বজনকে হত্যা করে-যুদ্ধাপরাধী বিচার-সাকার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ সাক্ষী

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬ষ্ঠ সাক্ষী এ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মা সোমবার জবানবন্দী ও সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন,


‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাক আর্মিরা ব্রাসফায়ার করে আমার মা, ভাই, দুই চাচা ও এক ভাগিনাসহ ৫ স্বজনকে হত্যা করেছে।’ জবানবন্দী প্রদানের সময় সাক্ষী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় এজলাস কক্ষে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দীতে সাক্ষী এ কথা বলেছেন।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গঠিত অভিযোগ পুনর্বিবেচনার আবেদনের বিষয়ে ১৫ জুলাই আদেশের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। একই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সোমবার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনাল তাদের ৬ আগস্ট মামলার নথি ও সাক্ষীর তালিকা উপস্থাপন করার তারিখ ধার্য করে। একই দিন রাষ্ট্রপক্ষকে তাদের সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীর জেরা শেষ হয়েছে। আজ দ্বিতীয় সাক্ষীর জবানবন্দী অনুষ্ঠিত হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আদেশগুলো প্রদান করেছে। জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটরের ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) ১৫ জুলাই তারিখ পুনর্র্নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাকা চৌধুরী ॥ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সোমবার ৬ষ্ঠ সাক্ষী এ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মা (৬৭) জবানবন্দী ও সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। তিনি জবানবন্দীতে বলেছেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাক আর্মিরা ব্রাসফায়ার করে আমার মা, ভাই, এক চাচা ও এক ভাগিনাকে হত্যা করেছে।’ ব্রাসফায়ারে ঘটনাস্থলেই তার পরিবারের ওই সদস্যদের মৃত্যু হয়।
উল্লেখ্য, এর আগে ২৫ জুন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে পঞ্চম সাক্ষী প্রফল্ল রঞ্জন সিংহকে আসামি পক্ষের জেরা শেষে আজ ৬ষ্ঠ সাক্ষীর জবানবন্দী পেশের তারিখ ধার্য করা হয়। এ পর্যন্ত প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আরও জবানবন্দী পেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ও দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এম সলিমুল¬াহ, মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরু বাঙালী, ও গৌরাঙ্গ চন্দ্র সিংহ। পরে তাদেরকে জেরা করে আসামিপক্ষ।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ হাজির করা হয়। ৬ষ্ঠ সাক্ষী নির্মল চন্দ্র শর্মা জবানবন্দীতে বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৩ এপ্রিল তার চোখের সামনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনারা ব্রাশফায়ার (গুলি) করে হত্যা করে তাঁর মা পঞ্চবালা শর্মা, বড় কাকা জ্যোতি লাল শর্মা, ছোট কাকা ডা. মাখন লাল শর্মা, ছোট ভাই সুনীল শর্মা ও ভাগিনা দুলাল শর্মাকে। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান তার বাবা জয়ন্ত কুমার শর্মা।
এ ঘটনায় শেষ মুহূর্তে কাত হয়ে পড়ে যাওয়ায় গুলি না লাগায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান সে সময়কার ২৫ বছরের যুবক নির্মল নিজেই। সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সাক্ষ্য দানকালে শহীদ ৫ জন স্বজনের হত্যাকারী হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে চিহ্নিত ও শনাক্ত করে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ওই গণহত্যার বর্ণনা দেন নির্মল চন্দ্র শর্মা। মধ্যাহ্ন বিরতির পরে তাঁকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
জবানবন্দীতে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকসেনারা হাটহাজারী বাস স্টেশন আক্রমণ করে। এই সংবাদ পাওয়ার পর আমরা দারুণ বিচলিত হয়ে পড়ি। কেননা এই বাস স্টেশন থেকে রাউজান পর্যন্ত আর কোন প্রতিরোধ কেন্দ্র ছিল না। এ অবস্থায় আমরা রাতেও ঘুমাতে পারিনি। সকাল বেলা ১৩ এপ্রিল মা বলেন যে, স্টেশনে যাই। কখন যেতে পারি তা ঠিক করিনি। যাওয়ার আগে ভাত খেয়েই বের হই। এই অবস্থায় আমি, আমার ভাই সুলীন শর্মা, বাবা জয়ন্ত কুমার শর্মা, ভাগ্নে দুলাল শর্মা যখন খাওয়ার চিন্তা করি, ঠিক সে মুহূর্তে বাড়ির উত্তর দিক রাঙামাটি সড়কের উত্তর পাশে হানিফ খন্দকার মসজিদ থেকে আজান দেয়া হয়। সেই মাইকের থেকে বলা হয় যে, তোমরা বাড়িঘর থেকে কোথাও যাবে না। শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাদি বাড়িঘর ছেড়ে যাও তা হলে লুটপাট হয়ে যাবে। কেউ বাড়িঘর ছেড়ে যেও না। কারও কোন অসুবিধা হবে না।
এ অবস্থায় আমরা আশান্বিত হলাম। ইতোমধ্যে আমার বড় চাচা জ্যোতিলাল শর্মা তাঁর পরিবার নিয়ে হাটহাজারী যাওয়ার জন্য অনেক দূর চলে গিয়েছিলেন। এই ঘোষণার পর আবার বাড়িতে ফিরে আসলেন। কিছুক্ষণ পর আমি দুলাল ও সুনীল ভাত খেতে বসলাম। আমার মা পরিবেশন করছিলেন। ভাত খাওয়া শেষ হতে কিছুক্ষণ বাকি ছিল। এ সময় দেখি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকবাহিনীসহ আমাদের ঘরের দরজায় উপস্থিত। সৈন্যদের মধ্যে একজন তাদের ভাষায় আমাদের বললÑ ভয় নেই। তোমাদের মারব না। তোমরা ঘরের বাইরে আস। বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাকে বললÑ হ্যান্ডস আপ। তখন আমি হাত উঁচু করে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে থাকে।
তখন একজন সৈন্য আমার দিকে এগিয়ে আসে। ৩ জনের মধ্যে ২ জন অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসে। আমি মাথা না নেড়ে চোখ দিয়ে তাদের অবস্থান দেখি। সবাইকে রক্ষার স্বার্থে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ অবস্থায় আমার মা, বাবা, ভাই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকল। আমার মা-বাবা তাদের পায়ে ধরে কান্নাকাটি ও আমার প্রাণভিক্ষা চাইতে থাকল। এই অবস্থায় তাদের মধ্য থেকে একজন বললÑ চুপ করো। ঘরের ভেতরে যাও। আমরা সবাই ভেতরে চলে যাই। ৪-৫ মিনিট পর আমার চাচা মাখন লাল শর্মা তার ঘর থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও পাক সেনারা নিয়ে আসে। এই অবস্থায় আমরা সবাই ঘরের ভেতর থেকে উঠানে চলে আসি এবং কান্নাকাটি করি।
আমার বড় চাচা জ্যোতিলাল শর্মা, ছোট চাচা ডা. মাখল লাল শর্মা, ভাই সুনীল চন্দ্র শর্মা, ভাগ্নে দুলাল চন্দ্র শর্মাকে সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা ঘিরে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। কেউ তাদের পায়ে ধরি। তখন সৈন্যরা আমাদের লাইন ধরে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু আমরা সবাই কাঁদতে থাকি। তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আমাদের থেকে ১৫ হাত দূরে সরে যায় এবং আমাদের বসতে বলে। আমরা ভাবলাম তাদের কথা না শুনলে ক্ষতি হবে। আমরা সবাই পশ্চিমমুখী হয়ে বসে পড়ি। এই অবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম দিক একটু আড়াআড়িভাবে আমাদের গুলি করতে উদ্যত হলো। ব্রাশফায়ার। গুলি করার মুহূর্তে পড়ে যাই।
দু’বার ব্রাশফায়ার করে। আমি চুপ করে পড়ে থাকি। কারণ আমি উঠলে আমাকে গুলি করবে। সবাই চুপ হয়ে যাই। আমি একটু গোঙানির শব্দ শুনি। উঠে দেখি সাকাসহ তারা পূর্বদিকে চলে যাচ্ছে। দেখলাম মায়ের পেটের বাম দিকে গুলি ঢুকেছে। পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। ভাগ্নে দুলাল শর্মাও নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। তারা মারা যায়। বড় কাকা যতীন্দ্রলাল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ছোট কাকা মাখললাল শর্মা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে মারা যান। বাবা ছিল স্বাস্থ্যবান। তার পা ও বাম হাতে গুলি লাগে। হাড় ভেঙ্গে যায়। গুলির শব্দ পেয়ে মেজভাই বিমল শর্মা আসেন। এই অবস্থা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। আহত অবস্থায় আমার বাবা পানি পানি করেছেন। বাবা আহত হয়ে জীবিত ছিলেন। ৫/৬ বছর পরে মারা যান।
এ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মার জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবী আহসানুল হক হেনা তাকে জেরা করেন। নিম্নে জেরার কিছু অংশ দেয়া হলো।
প্রশ্ন : আপনি একাত্তর সালে কি করতেন?
উত্তর : ব্যবসা করতাম।
প্রশ্ন : কোন্ সময়ে মাস্টারি করতেন?
উত্তর : করতাম।
প্রশ্ন : ৭১-এ করতেন না?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কোন্ সময় পর্যন্ত করতেন।
উত্তর : স্মরণে নেই।
প্রশ্ন : এসএসসি পাস করেছেন কবে?
উত্তর : ১৯৬৪ সালে।
প্রশ্ন : বিএ পাস করেছেন কবে?
উত্তর : স্মরণে নেই।
প্রশ্ন : ল পাস করেছেন কবে?
উত্তর : এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
প্রশ্ন : আপনি আইনজীবী হিসেবে চট্টগ্রামের বার-এ কখন যোগদান করেছেন ?
উত্তর : কাগজ না দেখে বলতে পারব না।
প্রশ্ন : আপনি বর্তমান সরকারের আমলে এজিপি হয়েছেন?
উত্তর : সঠিক নয়।
প্রশ্ন : এজিপি আছেন।
উত্তর : না।
প্রশ্ন :আপনার ভাই বিমল গ্রামে ডাক্তারী করেন।
উত্তর : সঠিক নয়, বাড়িতে থাকেন।
প্রশ্ন : কি করেন?
উত্তর: ওষুধের ব্যবসা করেন।
প্রশ্ন : তার কোন ট্রেড লাইসেন্স আছে?
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : আ্পনি শহরে থাকেন?
উত্তর : শহরে থাকি।
প্রশ্ন : আপনার পিতার কত জমি আছে?
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : আপনার পিতার মৃত্যুর পর সাকসেশন সার্টিফিকেট তুলেছেন?
উত্তর : নেইনি।
প্রশ্ন : ভাই সুনিলের ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছিলেন?
উত্তর : নেইনি?
প্রশ্ন : মা, ভাগ্নের ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছিলেন?
উত্তর: না।
প্রশ্ন : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ বিষয়ে থানায় কোন জিডি মামলা করেছিলেন?
উত্তর : করিনি।
প্রশ্ন : আলী চৌধুরী বাড়ি আপনার বাড়ি থেকে কত দূর?
উত্তর : আনুমানিক ৩০০ গজ উত্তর দিকে।
প্রশ্ন : ওটা বকশী আলী চৌধুরীর বাড়ি বলে পরিচিত।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : দানু এখন জীবিত আছে?
উত্তর : নাই ।
প্রশ্ন : দানুর বাড়ি আর সাকারবাড়ি একই পাড়ায়।
উত্তর : কাছাকাছি। একই বাড়ি নয়।
প্রশ্ন : তারা পরস্পর আতœীয়?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ : আপনি কখনও এজিপি হননি?
উত্তর : হইনি।
প্রশ্ন : আপনি কু-েশ্বরীর এমডি প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহকে চিনেন?
উত্তর : চিনি।
প্রশ্ন: তার সঙ্গে দেখা হয়েছে এর মধ্যে?
উত্তর : মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে।
প্রশ্ন : আপনাদের ওই ঘটনার কথা তাকে বলেছেন?
উত্তর : বলিনি।
প্রশ্ন : হানিফ খন্দকারের বাড়ি রাঙামাটি রোডের উত্তর দিকে।
উত্তর :ঠিক।
প্রশ্ন: কার্ফ্যুর সময় রাঙ্গামাটি রোডে গাড়ি চলেছিল।
উত্তর : পাক সেনাদের গাড়ি চলেছিল।
উল্লেখ্য, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১৪ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এ পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি এবং শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ ও পুত্র প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তাদের জেরা সম্পন্ন করেছে আসামিপক্ষ। ওই ৫ জন সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে সাকার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী নানা অভিযোগ তুলে ধরলেও প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী হিসেবে প্রথম সাক্ষ্য দিলেন এ্যাডভোকেট নিখিল চন্দ্র শর্মা।
আব্দুর আলীম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত (বর্তমানে শর্তসাপেক্ষে জামিন) বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সোমবার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশনপক্ষ। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রসিকিউশনের পক্ষের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত ও এ কে এম সাইফুল ইসলাম সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
সূচনা বক্তব্যে প্রসিকিউশন বলেছে, ১৯৭১ সালে আবদুল আলীম তৎকালীন বগুড়া জেলার জয়পুরহাট মহকুমায় একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে সেখানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে জয়পুরহাট মহকুমার সব থানায় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, হিন্দু সম্প্রদায়সহ সাধারণ মানুষকে হত্যা, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী এইএম খলিলুর রহমান তাঁদের সাক্ষীর তালিকা ও মামলার নথিপত্র উপস্থাপনের জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে সময় আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল তাঁদের ৬ আগস্ট মামলার নথি ও সাক্ষীর তালিকা উপস্থাপন করার তারিখ ধার্য করেন। একই দিন রাষ্ট্রপক্ষকে তাদের সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেন।
১১ জুন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করা ও উস্কানিমুলক বক্তব্য দেয়াসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে আব্দুল আলীম মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত হন।
মুজাহিদ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময মানবতবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গঠিত অভিযোগ পুনর্বিবেচনার আবেদনের বিষয়ে ১৫ জুলাই আদেশের তারিখ ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ সোমবার এ তারিখ ধার্য করে।
শুনানিতে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বলেন, আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আসামিকে আল বদর হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু গঠিত অভিযোগে তাঁকে বারবার আল-বদরের নেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটা যদি সংশোধন করা না হয়, তবে আসামি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।প্রসিিিকশনের পক্ষের আইনজীবী মোখলেসুর রহমান জবাবে বলেন, বিভিন্ন তথ্য ও নথি থেকে ট্রাইব্যুনাল যেটা সঠিক মনে করেছে, সেটিই করেছেন। আমরা আমাদের তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করে দেব, তিনি আল-বদরের নেতা ছিলেন।’
উল্লেখ্য, মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগে গঠনের পর ১ জুলাই এ আদেশের রিভিউ আবেদন। ২১ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে। আগামী ১৯ জুলাই ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর দিন ধার্য রয়েছে।
মুজাদিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, ফরিদপুর ও ঢাকাসহ সারাদেশে সাধারণ মানুষ হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ। মুজাহিদ একক ও দলবদ্ধভাবে সরাসরি জড়িত থেকে ও নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগিতা ও নির্দেশ দানের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
এর আগে গত ৫ জুন অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে আসামিপক্ষ এবং ২১ মে অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষ হয়।ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছর মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়।পরে একই বছরের ২ আগস্ট অন্যদের সঙ্গে মুজাহিদকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
কাদের মোল্লা ॥ এত্ত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনরেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ খানের জেরা শেষ হয়েছে। আজ দ্বিতীয় সাক্ষীর জবানবন্দী পেশের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান এ টিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীকে তার আইনজীবী একরামুল হক জেরা শেষ করেন।
কাদের মোল্লাকে সোমবার কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আজ প্রসিকিউশন পক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী পেশ করবেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন মামা বাহিনীর প্রধান’ ও কমান্ডার সহিদুল হক মামা।
নিজামী ॥ একই অভিযোগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটরের ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন ফের পিছিয়েছে। নিজামী অন্য মামলায় চট্টগ্রাম থাকায় আসামিপক্ষ সময়ের আবেদন জানান। চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ১৫ জুলাই তারিখ পুনর্র্নিধারণ করে। একই সঙ্গে ২২ জুলাই আসামিপক্ষকে তাদের সাক্ষী তালিকা ও তথ্য প্রমাণ সংবলিত কাগজপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।

No comments

Powered by Blogger.