দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-খসড়া আইনটি আর কতদিন ঝুলে থাকবে? by শেখ রোকন

আমাদের দুর্ভাগ্য যে সড়ক, বাঁধ ও অন্যান্য কৃত্রিম স্থাপনায় বন্যার প্রাকৃতিক গতিপথ বিনষ্ট করার অনেক পরে 'বন্যার সঙ্গে বসবাস' স্লোগানটি এ দেশে চালু হয়েছিল; কিন্তু ততদিনে স্বাভাবিক ও অনেকাংশে উপকারী বার্ষিক প্লাবনটিকে অস্বাভাবিক ও অপকারী জলাবদ্ধতায় রূপান্তরের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল। ফলে স্লোগান কেবল সভা ও নথিরই শ্রীবৃদ্ধি করেছে, বন্যাদুর্গতদের কাজে আসেনি।


শুধু বন্যা নয়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সাহসী সন্তানরা হাজার বছর ধরেই নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই কিংবা মৈত্রী করে টিকে থেকেছে। বছরের এক-দুই সপ্তাহ বন্যার উপযোগী জীবনযাত্রা, নদীর গতিপথ ঠিক রাখা, উপকূলীয় ভূমি উদ্ধার, জোয়ার-ভাটা কাজে লাগানোর কৌশলও তাদের অজানা ছিল না। কেউ যদি দাবি করেন যে, এখন দুর্যোগ বলে পরিচিত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়াগুলো আসলে ধীরে ধীরে আমাদেরই কিছু অবিমৃষ্যকারিতায় ক্রমে সত্যিকার দুর্যোগ হয়ে উঠেছে, তাহলে দোষ দেওয়া কঠিন।
তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে, সত্যিকার দুর্যোগ হয়ে ওঠা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে মোকাবেলার ক্ষেত্রেও বঙ্গীয় ব-দ্বীপের মানুষ সাফল্য ও সামর্থ্য প্রদর্শন করে আসছে। আমাদের মনে আছে, ২০০৫ সালে ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনায় বিপর্যস্ত পরাশক্তি আমেরিকা থেকেই দাবি উঠেছিল কীভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়, সে শিক্ষা স্বল্পোন্নত বাংলাদেশের কাছ থেকে নেওয়ার। অবশ্য এটাও স্বীকার করতে হবে, দুর্যোগ মোকাবেলায় বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সাফল্য কেবল এখানকার জনগোষ্ঠীর দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না। নীতিগত দিক থেকেও আটঘাট বাঁধতে হয়। দুর্যোগ মোকাবেলার কার্যক্রম সক্রিয় থাকে দুটি পায়ের ওপর ভর করে। প্রথমটি নিঃসন্দেহে জনসাধারণের সচেতনতা ও সক্ষমতা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আইনি কাঠামো। দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের নীতিগত অবস্থানও অনেক পোক্ত। দীর্ঘদিনের লড়াই ও প্রস্তুতির জন্যই যে নীতিগত দিক থেকে আমরা শক্ত অবস্থানে আছি, সেটা বোধহয় বলা যাবে না। দুর্যোগ মোকাবেলা যেন আমাদের জন্য অনায়াসে গ্রহণ করা চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখলাম, গোটা পৃথিবীর জন্য অভিন্ন ও বৃহত্তম বিপদ হিসেবে দেখা দেওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার নীতিগত প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশের বেশি সময় ক্ষেপণ হয়নি। আমরা সবার আগে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন বা নাপা তৈরি করেছি। পরে তৈরি হয়েছে ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন পল্গ্যান। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও এ বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে শিখতে চাচ্ছে। জলবায়ু সংক্রান্ত বৈশ্বিক তহবিলের জন্য হাত গুটিয়ে বসে না থেকে দুই দফায় ১৩শ' কোটি টাকার নিজস্ব তহবিলও দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের জাতীয় আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য মাঠপর্যায়েও চলছে বেশকিছু অ্যাডাপটেশন প্রকল্প।
সামগ্রিকভাবে একইভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমাদের নীতিগত প্রস্তুতি দীর্ঘ ও শক্তিশালী। এ বিষয়ে সরকারি কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি। পরে প্রতিষ্ঠিত হয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় (পরবর্তীতে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়)। ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনেই দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদফতর এবং ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি সরাসরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক দেখভাল করে আসছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, সংস্থা, সশস্ত্র বাহিনী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে আসছে। রয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি। ২০০৭ সালে জারিকৃত এবং ২০০৯ সালে পর্যালোচিত আমাদের 'দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি' দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে পাঁচ বছরমেয়াদি (২০১০-১৫) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জাতীয় পরিকল্পনা। তৃণমূলে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও রয়েছে বিভিন্ন পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিটি। আমার সন্দেহ আছে যে, বিশ্বের আর কোনো দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এত কর্তৃপক্ষ, বিধিবিধান ও কমিটি রয়েছে কি-না।
এর মধ্যে হতাশার একটি দিক হচ্ছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেওয়া কিংবা দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশে বহুদিন পর্যন্ত কোনো আইন ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, এতসব নীতি ও কাঠামো থাকা সত্ত্বেও আলাদা করে আইনের প্রয়োজন কেন? বর্তমানে জরুরি পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী স্থায়ী আদেশাবলি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু তার উদ্যোগের বাস্তবায়ন অনেকাংশে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছার ওপর। কারণ এর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। মন্ত্রীর পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত দেওয়াও সম্ভব নয়। দুর্যোগ মুহূর্তে আইনি ভিত্তি না থাকার বিপদ কেমন, সেটা প্রমাণ হয়েছিল ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময়। ওই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাপক ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ ছিল। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বন্দর থেকে জাহাজ সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছিল; কিন্তু যেহেতু এ ব্যাপারে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, সিদ্ধান্তটি আমলে নেয়নি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন হলে এ ধরনের জটিলতার অবসান হবে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও শক্তিশালী হবে। তারা বা তাদের পক্ষে কেউ চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
দুর্যোগ আইন প্রণয়ন করার বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না। ১৯৯৫ সালে জাপানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে 'হুগো ফ্রেমওয়ার্ক অব অ্যাকশন' স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ইতিমধ্যেই নিজ নিজ দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করেছে। আর বাংলাদেশ? দুর্যোগ মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখলেও আইন প্রণয়নের প্রশ্নে অজ্ঞাত কারণে বিলম্ব করে চলেছে।
অনেকে জানেন, প্রায় দু'দশক আগে, হুগো ফ্রেমওয়ার্ক অব অ্যাকশন স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই, ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে তা আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারও আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। তবে বিষয়টি আর এগোয়নি। তার বদলে তখন বরং প্রথমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ প্রণয়ন এবং পরে তা পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানলে আইনটি প্রণয়নের প্রশ্ন আবার সামনে চলে আসে এবং 'জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৮'-এর খসড়া তৈরি হয়। কিন্তু খসড়া আইনটি আর চূড়ান্ত হচ্ছে না। গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হয়েছিল; পরে পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সংবাদপত্রে খবর এসেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে, নাকি অধিদফতর_ এ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মন্ত্রণালয়। আবার কর্তৃপক্ষ গঠন করা হলে তার প্রধান কাকে করা হবে, এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিদফতর হলে সব সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আসতে হবে। কর্তৃপক্ষ হলে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।
এগুলো খুঁটিনাটি, কারিগরি দিক; নীতিগত দিক থেকে মোটাদাগের ব্যর্থতা হচ্ছে, দুর্যোগ মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আইনি কাঠামোতে আনার জরুরি কাজটি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বিলম্বই হচ্ছে এবং এ বিলম্ব অহেতুকই মনে হয়। এদিকে আইনটি নিয়ে টানাহেঁচড়ার মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সামনে বিরাট বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা এবং আন্তর্জাতিকভাবে দরকষাকষি কিংবা নিজেদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায়ও এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের মতো অভ্যন্তরীণ নীতিগত প্রস্তুতি কাজে আসে। কেউ কেউ এমন যুক্তি দিতে পারেন, খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করার পদে পদে বিলম্ব শাপে বরের মতোই হয়েছে। এখন খুব সহজেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়েও নতুন আইন যুক্ত করা যাবে। কিন্তু সে জন্য কত অপেক্ষা? সিডরের ভয়াবহতা দেখে আমরা দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে খসড়া আইন করেছিলাম। সেটা চূড়ান্ত হওয়ার জন্য যদি সিডরের মতো আরেকটি দুর্যোগের অপেক্ষা করতে হয়, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী আছে?

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.