জন্মদিন-সময়ের জীবন্ত আর্কাইভ by আবু সাঈদ খান

মুনতাসীর মামুন সম্পর্কে কিছু লিখতে পারা আনন্দের ব্যাপার; কিন্তু বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করব। তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত। কর্মধারা বহুমাত্রিক। তবে সব ক্ষেত্র ছাপিয়ে তার প্রধান পরিচয় তিনি ইতিহাসবিদ। তাই বলে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশুতোষ লেখক হিসেবে তার অবস্থান কম গুরুত্বপূর্ণ? কৈশোর থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন তিনি শিশুতোষ সাহিত্যে বিচরণ করেছেন, প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।


লিখেছেন গল্প ও উপন্যাস। অনুবাদেও সিদ্ধহস্ত। হ্যান্স অ্যান্ডারসনসহ বিশ্বসাহিত্যের বরেণ্য লেখকদের রচনা ও বিদেশি গল্পের তিনি সাবলীল অনুবাদ করেছেন।
ছাত্রজীবনেই সাপ্তাহিক বিচিত্রার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নিয়েছেন। কর্মজীবনে অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে নিলেও সাংবাদিকতার সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হয়নি। এখনও তিনি নিয়মিতভাবে সংবাদপত্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে নিবন্ধ লিখে চলেছেন।
ইতিহাস নিয়ে লিখছেন দুই হাতে। ঢাকা শহর আর এর গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে ঢাকার বহু দুষ্প্রাপ্য তথ্য ইংরেজ সিভিলিয়ানদের স্মৃতিকথাসহ নানা দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে তিনি গ্রন্থিত করেছেন। ঢাকা বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই রয়েছে। বিশেষ করে হৃদয়নাথের ঢাকা, ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, দেয়ালের শহর, ঢাকার প্রথম, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ছবির খোঁজে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকের ঢাকা ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে তার গবেষণা সিরিজ গ্রন্থমালা গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কাজ অসামান্য। মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথার পাশাপাশি রাজাকার ও শান্তি কমিটির ভূমিকাও তুলে ধরেছেন। সম্পাদনা করেছেন 'রাজাকার সমগ্র'। শান্তি কমিটির তালিকা প্রণয়নের কাজ করছেন এখন। একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যও যা করা কঠিন, ব্যক্তিগত আগ্রহে তা অনায়াসে করছেন তিনি। তাকে মনে হয়; জীবন্ত আর্কাইভ। এই আর্কাইভের কাছে রয়েছে আমার ব্যক্তিগত ঋণ। অনেকবার লিখতে বসে কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে তাকে ফোন করেছি। খুশি মনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, কখনও বাতলে দিয়েছেন রেফারেন্স।
বর্তমান সময়কেও তিনি ইতিহাসের অলিন্দে স্থান দিতে সদা তৎপর। দুই শতাধিক বইয়ের লেখক, সম্পাদক তিনি। তার বইয়ের তালিকা দেখে আমার বিস্ময় জাগে এত কাজ কী করে করেছেন! এর জন্য যে একাগ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা দরকার_ সে সবের একশ' ভাগই রয়েছে তার।
আমি ভাবি, এত কাজ করতে গিয়ে তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের বঞ্চিত করেছেন কিনা? না, এমন কথা তার শত্রুরাও বলবেন না। শিক্ষক হিসেবে তিনি সমান জনপ্রিয়, কর্তব্যপরায়ণ।
ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি ব্যতিক্রমী। ইতিহাস রচনা-সম্পাদনা-বিশ্লেষণ করেই তিনি ক্ষান্ত নন, ইতিহাস সৃষ্টিতে তিনি সমান উৎসাহী। তিনি একজন অ্যাক্টিভিস্ট। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছেন। তখন রাজপথেও তার উপস্থিতি ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্রত নিয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে তিনি এখনও আছেন।
স্বৈরাচার, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, ফতোয়াবাজিসহ সব অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার। এ জন্য তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে, সইতে হয়েছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন।
মুনতাসীর মামুন যা বিশ্বাস করেন, তা অকপটে বলেন। তার ভাষা চাঁছাছোলা। এ কারণে বন্ধুবৎসল মুনতাসীরের শত্রুর সংখ্যাও অগণন। কেবল শত্রুর উদ্দেশে নয়, বন্ধুদের উদ্দেশেও উচিত কথা বলতে তিনি পারঙ্গম। সত্যভাষণে তার কাছে শত্রু-মিত্র বাছবিচার নেই।
মুনতাসীর মামুন কেবল নিজেই কাজ করেন না, অন্যদেরও উৎসাহ দেন। মনে পড়ে, আমার 'মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর' বইটির একটি কপি তাকে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সেটি দেওয়ার আগেই তিনি ফোনে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। আমি জানতে চাইলাম, বইটি কোথায় দেখেছেন। তিনি বললেন, কেন আমি কিনেছি। একজন বড় মাপের লেখক হয়ে আমার মতো সামান্য লিখিয়ের বই কিনেছেন, জেনে প্রীত হলাম। আমার 'স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি' বইটির ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটল। বইটি লেখার আগে তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বইটি যে তাকে প্রেজেন্ট করব তা নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার দেওয়ার অপেক্ষা না করে আমার অজান্তেই কিনে নিলেন। সমসাময়িক অনেক লেখকের বই তিনি কেনেন এবং পড়েন। পড়া ও লেখা_ দুইয়ে অখণ্ড মনোযোগ।
শুভ্র গোঁফধারী মুনতাসীর মামুনের মধ্যে রয়েছে অমিত তারুণ্য। সৃষ্টিতে তার ক্লান্তি নেই। এই কর্মপাগল মানুষটির ৬০তম জন্মবার্ষিকীতে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.