সময়ের প্রতিধ্বনি-আওয়ামী লীগের সমালোচনার মুখে সরকার by মোস্তফা কামাল

এবার সরকার আওয়ামী লীগের সমালোচনার মুখে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা কয়েকজন মন্ত্রীর তুখোড় সমালোচনা করছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ছিল গত শনিবার। গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন।


প্রধানমন্ত্রী নেতাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং নিজেও বক্তব্য দিয়েছেন। বৈঠকে সাংগঠনিক বিষয় ছাড়াও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পৌর ও উপনির্বাচনের ফল বিপর্যয়, দ্রব্যমূল্য ও বাজার সিন্ডিকেট, শেয়ারবাজার, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দল, দলের সাংগঠনিক সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে মন্ত্রীদের বেফাঁস কথাবার্তা নিয়ে কয়েকজন নেতা সাহস করেই বক্তব্য দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা ও সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে ছদ্মবেশী ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে। তারা খুব কাছে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের মন্ত্রীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সভাপতিদের কথা আর কাজে কোনো মিল নেই। বড় বড় মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতিরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে রাজনৈতিক বলছেন। এটা সমন্বিত সরকার হলো না। তিনি অর্থমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে বিভিন্ন পদস্থ লোকদের পদত্যাগ দাবি করেন। (কালের কণ্ঠ, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১১)
প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল লোটাস শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে রাজনৈতিক বলে উল্লেখ করেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ব্যাপক সমালোচনা হয়। অবশ্য শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে বাইরেও সমালোচনা হয়। তিনি শেয়ারবাজার ধসের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন। শুধু দায়ী করে বসে থাকলে চলবে না। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, শেয়ারবাজার ধসের পেছনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু ব্যবসায়ী দায়ী। এদের মধ্যে বেঙ্মিকো গ্রুপের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সালমান রহমান, বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিএনপির মোসাদ্দেক আলী ফালু প্রমুখের নাম বারবার আসছে। তাঁরা নাকি বাজার থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ঘটনার পর সরকার একটি তদন্ত কমিটিও করেছে। এ সময় শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। যাহোক, তদন্ত কমিটিকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কি না, তা নিয়েও মানুষের মধ্যে সংশয় আছে। তবে আমরা আশা করি, স্বচ্ছতার স্বার্থে সরকার তদন্ত কমিটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে এবং জনসমক্ষে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে আরো কিছু বিষয় উঠে এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনার দাবি রাখে। কারণ শুধু গণমাধ্যম নয়, সাধারণ মানুষও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বর্তমানে দেশের একটি অংশ নাশকতার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আরেকটি অংশ সরকারের ভেতরে থেকে ষড়যন্ত্র করছে, যা ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে শুরু করেছেন। আমরা লক্ষ করছি, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাদের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, আসন্ন বিশ্বকাপে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানো হতে পারে। এ ব্যাপারে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উঠে এসেছে বাজার সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ। এ নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। সভায় বেশ কয়েকজন নেতা বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে হাওয়া ভবনের সৃষ্ট সিন্ডিকেট এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে মানুষের প্রশংসা পাওয়া যাবে। (কালের কণ্ঠ, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১১)
এর আগে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, বাজার সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। এ নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী বলে বসলেন, বাজার সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। তিনিই বলেন, সিন্ডিকেট আছে, আবার তিনিই বলেন, নেই। আমরা কোনটা সত্য ধরে নেব?
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের নামের তালিকা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, টিকে গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, পারটেঙ্ গ্রুপ ও সিটি গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন নেতারা। এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রীর কোনো ধারণা আছে কি না, জানি না। তবে ধারণা না থাকলে বলব, বাণিজ্যমন্ত্রীর জন্য বিষয়টি লজ্জার এবং এটা তাঁর ব্যর্থতাও। এই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী দুটি কাজ করতে পারেন। এক. সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বাজারকে স্বাভাবিক করতে পারেন। দুই. তিনি ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতে পারেন। অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেকে ব্যর্থ বলতে মোটেই রাজি নন। তিনি বলেন, অবাধ বাণিজ্যের এই যুগে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাজার যেদিকেই যাক, তাতে বাণিজ্যমন্ত্রীর কি আসে যায়। তাঁর মন্ত্রিত্ব টিকে থাকলেই হলো।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, প্রয়োজনে উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করবেন। এখন আবার রেশন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব উঠেছে। খোলাবাজারে সরকার চাল বিক্রি করছে বাজার স্বাভাবিক রাখার জন্য। এসব উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। তবে রেশনের মাল যাতে নেতাদের ঘরে না ওঠে, সে বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে। এর আগের বার (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দুটি বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। এবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু গলদ রয়ে গেছে। এগুলো অতি দ্রুত দূর করতে হবে। একইসঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা, খোলাবাজারে চাল বিক্রি ও রেশনিং ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হেলাফেলা করা হলে কিংবা শৈথিল্য মনোভাব দেখালে বেকায়দায় পড়তে হবে।
এটা ঠিক, সারা বিশ্বেই খাদ্যদ্রব্যের দাম বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দাম থাকলে ব্যবসায়ীরা ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বাজারে বিক্রি করবে না। আবার, ব্যবসায়ীরা যাতে অতিমুনাফা করতে না পারে, সে দিকটির প্রতিও নজর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজারে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। বাজার স্থিতিশীল রাখা সরকারের দায়িত্ব। হঠাৎ হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে আর সরকার বলবে, মুক্তবাজার ব্যবস্থায় মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তা হয় না। বাজার ঠিক রাখতে সরকার ব্যবসায়ীদের কিছু সুবিধা দিতে পারে। আমদানি পণ্যে শুল্কহার কমিয়ে দিতে পারে। এ ছাড়া, আমদানি করতে গিয়ে যাতে ব্যবসায়ীদের ঝক্কিতে পড়তে না হয় সেজন্য সরকারকে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। মোট কথা, সরকার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখন ঐক্য দরকার। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে কাজ করতে হবে।
আমরা জানি, বর্তমান সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার কারণে জঙ্গিরা দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে তৎপর রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তও চলছে। এ কাজে বিরোধীপক্ষ উস্কানি দিতে পারে। তাতে তারা যে খুব একটা লাভবান হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এতে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। এ বিষয়টি বিরোধীপক্ষকে চিন্তা করতে হবে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে গিয়ে তাঁরা যেন বড় ক্ষতি ডেকে না আনেন।
সরকারের সব কাজে বিরোধী দল সহযোগিতা করবে না, এটা আমরা বুঝি। কিন্তু সব কাজে বিরোধিতা করবে, এটাও আমরা চাই না। জাতীয় ইস্যুতে আমরা সরকার ও বিরোধী দলের সমঝোতা আশা করি। কিন্তু সেই সমঝোতার কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না। বরং বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করা হচ্ছে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, সরকারকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে হলে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। সঠিক তথ্য সরকারের জানতে হবে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হলে সরকারকে বিপদে পড়তে হবে। বিভিন্ন সময় আমরা তার নজির দেখেছি। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার সমালোচনাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.