ওদের ক্লাইভরা, আমাদের মীরজাফররা তো আছেই! by মমতাজ লতিফ

পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক প্রধান যিনি সবেমাত্র সরকারের কাছে ফান্ড প্রত্যাহার করে নেবার পত্রটি স্বাক্ষর করে তাঁর টার্ম শেষ করেছেন, তাঁর আকস্মিক এই পদক্ষেপ, তা নিয়ে এদেশের সুশীল সমাজের নানা মত, সরকারের প্রতিক্রিয়া, সব মিলিয়ে দেশময় বেশ একটি হৈ চৈ পড়ে দিয়েছে।
যদিও বিশ্বব্যাংক গত দু’তিন বছরে এই ফান্ড নিয়ে নয়, ফান্ড তো ছাড়ই হয়নি, ফার্ম বা কাজ করার জন্য সংস্থা নিয়োগে দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার অস্পষ্ট সম্ভাবনার অভিযোগ করেছে দীর্ঘদিন যাবত এবং অভিযোগটি স্পষ্টভাবে জনগণ এখনও জানতে পারেনি কেননা তদন্তকালীন সময়ে কে কি করেছে, সেই সিদ্ধান্তে আসা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
বিষয়টি শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দেখলে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক একবার এক পা এগোয় আবার দু’পা পেছায়। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী বদল হলো। নতুন মন্ত্রী এল, তারপরও আজ এক পা এগোয়, তো কাল দু’পা পিছানোর প্রক্রিয়াটিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। শেষে নতুন মন্ত্রী পদ্মা সেতুর নতুন অর্থদাতার সন্ধানে নেমে পড়লেন এবং মালয়েশিয়া সরকার এতে আগ্রহ দেখায়। বিশ্বব্যাংককে ক্রুদ্ধ না করে বলা হলো এটি হবে পদ্মা দ্বিতীয় সেতু।
যা হোক আমার বক্তব্য হচ্ছে, পশ্চিমা সাদা মানুষদের কতগুলো ক্রিয়া-কর্মকে তামাটে পূর্ব দেশীয়রা অর্থ আয়ের বা ব্যবসাকর্ম হিসেবে আগে গণ্য করতে জানত না, পরে সেসব ক্রিয়া-কর্মকে শ্বেতাঙ্গ পশ্চিমাদের কাছ থেকে মহামূল্যবান ব্যবসা বা অর্থ আয়ের ক্রিয়া-কর্ম হিসেবে গণ্য করতে শিখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পেশাগত গবেষণা বা কর্মসূচী বা প্রকল্প মূল্যায়ন ইত্যাদির জন্য ‘কনসালটেন্ট’ বা ‘পরামর্শক’ নিয়োগ করার রীতি গ্রহণ করে এবং অফিসের মূল কাজগুলো ক্রমে দেখা যায় এই কনসালটেন্টগণই উচ্চ মূল্যের বেতনে করে থাকে। অফিসের মূল কর্মকর্তারা দৈনন্দিন কাজগুলো ঢিলে ঢালাভাবে করে থাকে। বলা চলে, এর মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ-কনসালটেন্টরা কল্পনার অতীত অতি অসম উচ্চ সম্মানী গ্রহণ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এক ধরনের, সঠিকভাবে বললে বলতে হয়, নতুন ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করেছে। এখন তো পথেঘাটে ‘পরামর্শক’বৃন্দকে দেখা যায়। শুরুতে আমিও এক সময় ইউনিসেফের ‘কনসালটেন্ট’ হয়ে দু’বছর কাজ করেছিলাম। প্রবেশের সময় ভেবেছিলাম আমার শিশুর শৈশবকালীন যতœ ও বিকাশের ক্ষেত্রে যেটুকু জ্ঞান মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে লাভ করেছিলাম তা আরও ভালভাবে বড় ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করার সুযোগ লাভ করব। বেশি কথা খরচ করার দরকার নেই, দেখলাম বলতে গেলে রেগুলার কর্মকর্তারা কয়েকদিন পর পর এর ওর জন্ম দিন, বিয়ে ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান করায় ব্যস্ত থাকে। তাদের কাজকর্ম মাস শেষের বিশাল অঙ্কের বেতনের তুলনায় নস্যি আর সে সময়ের কনসালটেন্টদের বেতন ছিল নিয়মিতদের চেয়ে অনেক কম। কাজ ছিল অনেক বেশি। যদিও সেসব কাজ ফাইলে জমে থাকে। ‘হেলথ’ সেন্টার ছাড়া অন্যত্র সেগুলোর বেশিরভাগ আলোর মুখ দেখে না। তাহলে এরা কি বর্ষশেষে ‘কাজ’ দেখাতে পারে না? সেগুলো দেখায়। বার্ষিক অগ্রগতি প্রতিবেদনগুলো কেন্দ্রীয় অফিসগুলো বাইরের ‘কনসালটেন্ট’-এর সহযোগিতায় ঝাঁ চকচকে, উন্নতমানের কাগজে উন্নতমান নিয়েই প্রকাশ করে এবং এগুলোতে খুব বেশি কাজের মালমসলা না থাকলেও এরা প্রথম দেখায় বাজিমাত করে দেয়। এ হিসাবে উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর খবধৎহরহম ঃড় নব বা ঞযব ঞৎবধংঁৎব রিঃযরহ খবধৎহরহম ঃড় ষরাব ঃড়মবঃযবৎ, অফঁষঃ ঊফঁপধঃরড়হ ইত্যাদি অসাধারণ প্রকাশনা আমাদের মতো মানুষকে কিছুটা শিক্ষিত করেছে যেগুলো প্রকাশনার জন্য গঠিত হয়েছিল অতি উচ্চমানের মেধাবী আন্তর্জাতিক প-িতজনের সমন্বয়ে বিশেষ কমিশন। ইউনেস্কোর নিয়মিত কর্মকর্তারা ওই কমিশনে কাজ করেনি। সুতরাং বড় বড় সংস্থা, অফিসসমূহের বড় কর্মকা-গুলো টেন্ডারের মাধ্যমে ‘পরামর্শক’ দল নিয়ে গঠিত ফার্মগুলো সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ‘কাজ’ লাভ করে যাতে বিদেশী পরামর্শকদের সম্মানী বা বেতন দেশীয় পরামর্শকদের চাইতে দশগুণ হতেও দেখেছি। একবার একটি ফার্মের কনসালটেন্ট হয়ে দেখেছি এসব অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব করে কিছু ‘পরামর্শক’ বিপুল অর্থ আয় করে বটে কিন্তু দেশের কি প্রাথমিক কি মাধ্যমিক স্তরে এসব বিপুল অর্থ ব্যয়ে করা কাজ বিশেষ কোন উপকারই করেনি। প্রকল্প মূল্যায়নে বাস্তবায়নকারী বেসরকারী সংস্থাগুলোর নানা গোঁজামিল দেওয়ার অদ্ভুত কৌশল দেখে হতাশ হয়ে কনসালটেন্সি আর করব না বলে এ কাজ ছেড়েছি। একমাত্র সরকারী কাজ দিয়ে সরকারী স্কুলে কিছু পরিবর্তন আনতে পেরেছিলাম আমরা একদল শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক প্রশিক্ষক। সেটিই আমাদের সান্ত¡না হয়ে আছে।
জানতে পারছি পদ্মা সেতু নিয়ে একটি সংস্থাকে সুপারভাইজরি কাজ পাইয়ে দিতে না পেরে একটি ষড়যন্ত্রকারী দল বিশ্বব্যাংককে নিয়মিত ই-মেইলে নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা কাজ পেতে যাচ্ছিল তাদের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির চিত্র উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল। ওই মেইলগুলো বিশ্বব্যাংক নিজেই সরকারের কাছে পুনঃ ফরোয়ার্ড করে দেয়। ফলে ষড়যন্ত্রটি প্রকাশ পায়। আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে, ঠিক এমনি ঘটনা ঘটেছিল আমি যখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত একটি আন্তঃত্রিদেশীয় গবেষণা টিমের সদস্য হয়ে কাজ করছিলাম। এটি বিশ্বব্যাংকের পক্ষে একটি নরওয়েভিত্তিক ফার্ম করছিলÑতিনটি দেশে, বাংলাদেশ, কলম্বিয়া ও ইথিওপিয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে কিভাবে, কেন স্কুলগুলোর উন্নতি ঘটেছিল, তা জানার উদ্দেশ্যে তিন দেশে তিনটি কমিটি হয়েছিল। আমরা দীর্ঘদিন অবহিত ছিলাম না যে, আমাদের টিম লিডার আমার বিরুদ্ধে নরওয়ের সংস্থার কাছে ঘন ঘন ফ্যাক্সে প্রেরিত অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছিল, যেমনÑআমি ভারতের চর, আমার লেখাপড়া নিম্নমানের, ভারত থেকে আসা কারিকুলাম উপদেষ্টার সাথে আমার অতি দহরম-মহরম রয়েছে ইত্যাদি। আমার জানা ছিল না, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একজন মহিলা কর্মকর্তা আমার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে এসেছিলেন আমার তদানীন্তন সরকারী অফিসে। ওই গবেষণার আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে আমার কেস স্টাডি দুটো প্রকাশিত হয় এবং টিম লিডারের সব ফ্যাক্স পত্র ওরা আমাদের সব সদস্যকে পুনরায় পাঠিয়ে দেয়। অন্য সদস্যরা খুব লজ্জিত হয়েছিল, মনে পড়ে। সম্মানীর ব্যাপারে কোন নিয়মনীতির বালাই ছিল না, আমারা যা পেয়েছি শ্বেতাঙ্গ গবেষকরা শতগুণ বেশি পেয়েছিল যা আমরা কাগজপত্র না দেখেও বুঝতে পেরেছিলাম।
শ্বেতাঙ্গ পাশ্চাত্যবাসীরা পূর্ব দেশীয়দের আরও একটি বৃত্তি বা পেশা উপহার দিয়েছেÑযাদের নাম আগে ছিল দালাল, এখন পাশ্চাত্যের ভদ্র নামÑলবিস্ট। এরা এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী। বাংলাদেশে এমন কোন বিদেশী কোম্পানি টেন্ডারে কাজ পেতে লবিস্ট নিয়োগ করে নাই এমন হতে পারে না। এমন কি আমাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য, ’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ আইনটির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য চল্লিশ বছরে অর্থে বিত্তে ফুলে-ফেঁপে ওঠা যুদ্ধাপরাধী দল একের পর এক শ্বেতাঙ্গ লবিস্ট নিয়োগ করছে, যারা টিভিতে, ম্যাগাজিনে প্রচারণা চালাচ্ছে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলী একটি মার্কিন লবিস্ট ফার্মকে তিনবারে ৭৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে মর্মে তথ্য বের হয়েছে যার ফটোকপি দেখলাম, ড. আবুল বারকাতের শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মারক বক্তৃতা প্রদানের সময়। এই লবিস্টরা নৈতিক-অনৈতিক, সব কাজই টাকার বিনিময়ে করে থাকে। এটি পাশ্চাত্য ও মার্কিন দেশে মান্যগণ্য বৃত্তি বা পেশা। তাহলে, কোন কোম্পানিকে কাজ দেবার জন্য দেনদরবার করা অর্থাৎ লবিং করা দোষের কিছু হয় কি? যেসব ব্যক্তি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছে, প্রচার প্রচারণা করছে, তারা তো সজ্ঞানে যারা স্বজাতির গণহত্যাকারী, ধর্ষক, লটেরাদের, সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা, বাছাই করা বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের হত্যা করে স্বজাতিকে মেধাশূন্য করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তাদের পক্ষের লবিস্ট হয়েছে। তারা কি অপরাধী নয়? আমাদের দেশের ট্রাইব্যুনালে তারা যদি বক্তব্য দেয় যা হবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ সমর্থন করে, তাহলে তা কি যুদ্ধাপরাধীদের মিত্র হিসেবে ‘অন্যায়কারী’ চিহ্নিত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হবে না?
এর আগে শোনা গিয়েছিল, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংককে অর্থ বরাদ্দ না করতে সরকার বিরোধী একটি লবিস্ট গ্রুপ বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করেছে। এ ঘটনা সত্য হলে তাদের জনগণের ও দেশের স্বার্থহানিকারী, দেশপ্রেমহীন মানুষ বলেই গণ্য করতে হবে কেননা পদ্মা সেতু সরকারের নয়, জনমানুষের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। দেশের কোন কোন ব্যক্তি ও দলের শ্বেতাঙ্গপ্রীতি ও শ্বেতাঙ্গ তোষণ অনাবশ্যকভাবে উচ্চমাত্রায় প্রদর্শিত হতে দেখা যাচ্ছে যা তাদের নিজেদের জন্যই মর্যাদাহানিকর। শ্বেতাঙ্গদের সুপারিশ এই উত্তর উপনিবেশকালেও এত বেশি প্রয়োজনীয় হলে তারা আমাদের আত্মমর্যাদাহীনই গণ্য করবে যার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
সবশেষে, সরকারকে জনগণের কাছ থেকে অর্থ তোলার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে ফান্ড তৈরি করে সে ফান্ড দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করতে অনুরোধ করব এবং এ পন্থায় আত্মনির্ভরশীল জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আরেকবার আত্মমর্যাদার স্বাদ পেতে দিতে বলব। জনগণ নিজেদের অর্থে নিজেদের সেতু তৈরি করুক।

No comments

Powered by Blogger.