সমকালীন প্রসঙ্গ-রাঙামাটিতে ইউপিডিএফের ওপর সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলা by বদরুদ্দীন উমর

সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সন্ত্রাসীরা ২১ মে ২০১১ তারিখ সকালে রাঙামাটির বরকল উপজেলার নারাইছড়ি গ্রামে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) চার কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে।


ওই গ্রামের বাসিন্দা রিপন চাকমা বলেন, ইউপিডিএফের ছয় কর্মী কয়েকদিন আগে এসে অরুণ চাকমার বাসায় ছিলেন তাদের এক বৈঠক উপলক্ষে। ২০ মে শুক্রবার মধ্যরাতে পিসিজেএসএসের কিছুসংখ্যক সশস্ত্র কর্মী অরুণ চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং সকালে যখন ইউপিডিএফের কর্মীরা নাস্তা করছিলেন তখন তাদের ওপর গুলি চালায়। (উধরষু ঝঃধৎ ২২.৫.২০১১) গুলিতে যারা নিহত হন তারা হলেন ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অনিমেষ চাকমা, পূর্ণভূষণ চাকমা (নবদ্বীপ), পুলক জীবন চাকমা (বিবেক) ও শুক্র সেন (প্রবীণ)।
ইউপিডিএফ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পিসিজেএসএসকে দায়ী করলেও পিসিজেএসএসের এক মুখপাত্র হত্যার ব্যাপারে তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, খুন ও সহিংসতার সঙ্গে তাদের লোকদের কোনো সম্পর্ক নেই! এ কাজ ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল! সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সম্পর্কে আবদ্ধ পিসিজেএসএসের পক্ষ থেকে এ ধরনের মিথ্যাচার কোনো নতুন ব্যাপার নয়। সন্ত্রাসী অপকর্মের পর প্রতিবারই তারা এ ধরনের রুটিন কথাবার্তা বলে থাকে। কিন্তু তাদের এই মিথ্যা এতই স্পষ্ট যে, এ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই।
রাঙামটির ডেপুটি কমিশনার সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, পিসিজেএসএসের সশস্ত্র কর্মীরাই এই আক্রমণের জন্য দায়ী। (উধরষু ঝঃধৎ ২২.৫.২০১১) স্থানীয় লোকেরা বলেছেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অরুণ চাকমার বাড়িতে ইউপিডিএফের কয়েকজন কর্মী একত্রিত হয়েছিলেন। তারা নাস্তা খাওয়ার সময় পিসিজেএসএসের লোকেরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। (ওই) বরকল থানার সাব-ইন্সপেক্টর ইদ্রিস আলী বলেন, অরুণ ও তার পরিবার অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। (ওই)
সকল প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএসের লোকেরাই সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে পরিকল্পিতভাবে ইউপিডিএফের কর্মীদের হত্যা করেছে। ইউপিডিএফের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে তারা নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তারা যে কথা বলেছে এটা তারা রুটিনের মতো করে সব সময়ই বলে থাকে। সন্তু লারমা প্রকাশ্যে সরকারের কাছে প্রায়ই দাবি করেন ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার! সরকার যাতে এ কাজ করতে পারে তার জন্য প্রায়ই তারা ইউপিডিএফের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে উল্টো তাদের দোষারোপ করে ইউপিডিএফ নিষিদ্ধকরণের অজুহাত খাড়া করতে চেষ্টা করে। সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার পর থেকে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বন্ধ করলেও তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সমানে সন্ত্রাস চালিয়ে আসছে। একদিকে গদিতে বসে মাখন-রুটি খেয়ে, অন্যদিকে সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না বলে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করতে তিনি কোনো অসুবিধা বোধ করেন না! অন্যদিকে সরকারের সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ধরনের অপকর্ম করতেও তার কোনো অসুবিধা নেই! পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে সেখানকার জনগণের দুর্দশা-দুরবস্থার জন্য তিনি সাংবাদিকদের সামনে ও সভা-সমিতিতে বিলাপ করলেও সরকারি গদি আঁকড়ে থেকে চুক্তির মহিমায় প্রাপ্ত সকল সুযোগ-সুবিধা বেশ নিশ্চিন্তেই ভোগ করছেন! দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের দুরবস্থা দূর করার জন্য মাঠে নেমে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার ক্ষমতা তার ও তাদের সংগঠনের আর নেই। কাজেই একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জন্য তিনি অশ্রুপাত করছেন এবং অন্যদিকে সরকারের দেওয়া মাখন-রুটি খাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফই সেখানকার জনগণের বিভিন্ন সমস্যাকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করছে। এ কথা আজ ওয়াকেফহাল মহলের সকলেরই জানা যে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএস নয়, ইউপিডিএফই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে সেখানকার সব থেকে বড়, সুসংগঠিত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। ইউপিডিএফের এই শক্তি বৃদ্ধিতে দিশেহারা হয়ে সন্তু লারমা বেশ কিছুদিন থেকেই সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন, ইউপিডিএফকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে! সরকারের খাস লোক না হলে এ ধরনের আবেদন কি কেউ সরকারের কাছে করতে পারে! রাজনীতির মাঠে নিজেদের পূর্বপ্রভাব টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফকে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করে সন্তু লারমা নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার যে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তার থেকে নিকৃষ্ট ব্যাপার আর কী হতে পারে?
কিন্তু সন্তু লারমা ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য যতই আবদার করুন, সরকারের পক্ষে তার আবদার রক্ষা করা সহজ নয়। কারণ কোনো সুনির্দিষ্ট ও গ্রাহ্য কারণ ছাড়াই ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে তার প্রতিক্রিয়া হবে, অনর্থক সেখানে পরিস্থিতি অনেক অশান্ত হবে, যার ফলে সরকারের কোনো সুবিধা না হয়ে তাদের জন্য অসুবিধাই সৃষ্টি হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতিনিধি ও নেতা হিসেবে সরকার সন্তু লারমাকে গদিতে বসিয়ে রাখলেও শান্তি চুক্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত এত বছরেও সেই গদির জন্য কোনো নির্বাচন হয়নি। সরকারের আজ্ঞাবহ লোক হিসেবেই তিনি গদিনসিন আছেন। এভাবে গদিনসিন থেকে তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই নানা চক্রান্তে লিপ্ত আছেন এমন নয়, সমতল ভূমির আদিবাসী নামে ঘোষিত জাতিগত সংখ্যালঘুদের নেতা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের কিছু লোককে নিয়ে তিনি একটি সংগঠন খাড়া করেছেন। এ কাজে তার সহায়ক হচ্ছে কিছু এনজিওওয়ালা। এই এনজিও ব্যবসায়ীরা 'আদিবাসীদেরকে' ব্যবহার করে বিদেশ থেকে অনেক সাহায্য আনে। এই নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর অনেক মৌলিক সমস্যা থাকলেও তার জন্য কোনো মাথাব্যথা এদের নেই, কোনো সংগ্রাম নেই, সংগ্রামের কর্মসূচি নেই। মাঝে মাঝে এরা এই গরিব জাতিগত সংখ্যালঘুদের জড়ো করে নৃত্যগীতের ব্যবস্থা করে তাদের ঘিরে প্রচার কাজ চালায়। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিজেদের জাহির করে; কিন্তু তাদের ঘাড়ে যে শোষণ-নির্যাতন চড়ে আছে তার বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রামের কর্মসূচি এদের নেই। উপরন্তু এই গরিবদের একত্রিত করে, নাচ-গানের মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ করে তারা সংগ্রামের কর্মসূচি থেকে তাদের দূরে রাখে।
এখানে এ প্রসঙ্গটির অবতারণা করার কারণ এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে যেভাবে অনেক ধরনের বিভ্রান্তিমূলক কাজ করছেন, জনগণের দৃষ্টিকে তাদের মূল সমস্যা থেকে সরিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন, সে ধরনের কাজ শাসক শ্রেণীর পক্ষে তিনি অন্যত্রও করার চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে শাসক শ্রেণীর বাম অংশের সঙ্গেও তার ভালো আঁতাত আছে। এ কারণে তারা অনেকে তার ইউপিডিএফ নিষিদ্ধকরণ দাবিরও সমর্থক! তাদের সঙ্গে পিসিজেএসএসের ও সন্তু লারমার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ।
সন্তু লারমার পায়ের তলার মাটি যতই সরে যাচ্ছে ততই তাদের সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই অন্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সুবিধা করতে না পেরে তারা সরকারের সাহায্যে প্রতিপক্ষ দমনের চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য একদিকে যেমন তারা সরকারের কাছে আবদার জানাচ্ছেন ইউপিডিএফ নিষিদ্ধকরণের, তেমনি অন্যদিকে তারা গণআন্দোলনের পরিবর্তে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। ২১ মে রাঙামাটিতে ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
২৩.৫.২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.