জবানবন্দিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী নির্মল শর্মা-মা-ভাইসহ পাঁচ স্বজনকে হত্যার সময় সেনাদের সঙ্গে সাকা চৌধুরী ছিলেন

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী নির্মল চন্দ্র শর্মা (৬৭) জবানবন্দিতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর মা, ভাইসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। সেনাদের গুলিতে তাঁর বাবা পঙ্গু হন। ওই সময় সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিলেন।


বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ চট্টগ্রামের আইনজীবী নির্মল গতকাল সোমবার জবানবন্দি দেন। ওই হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
আসামির কাঠগড়ায় সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে জবানবন্দিতে নির্মল বলেন, তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান থানার মধ্যগহিরা গ্রামে। একাত্তরে হাটহাজারী থানার দীঘির উত্তর পাড়ে মুক্তিকামী মানুষের একটি প্রতিরোধ কেন্দ্র ছিল। ১২ এপ্রিল ওই প্রতিরোধ কেন্দ্র অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনারা হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়। এ খবরে তাঁরা বিচলিত হয়ে পড়েন। ১৩ এপ্রিল তিনি, তাঁর ভাই সুনীল শর্মা, ভাগনে দুলাল শর্মা ও বাবা জয়ন্ত কুমার শর্মা বাড়ির উত্তরে রাঙামাটি সড়কসংলগ্ন হানিফ খন্দকারের মসজিদের মাইক থেকে একটি ঘোষণা শোনেন। ওই ঘোষণায় বলা হয়, শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে গেলে লুট হয়ে যাবে, বাড়িতে থাকলে কারও কোনো সমস্যা হবে না। এর আগেই তাঁর বড় চাচা জ্যোতিলাল শর্মা সপরিবারে হাটহাজারীতে তাঁর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। অনেক দূর চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ঘোষণায় তিনি আশ্বস্ত হয়ে আবার সপরিবারে বাড়ি ফেরেন। এরপর তাঁদের ভাত খাওয়ার শেষ দিকে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় তাঁদের ঘরের দরজায় উপস্থিত হন। সেনাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ভয় নেই, তোমাদের মারব না, ঘরের বাইরে আসো।’
নির্মল বলেন, ‘বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাকে বলে, “হ্যান্ডস আপ।” আমি হাত ওপরে তুলি, ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিল। দুজন পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র তাক করে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার মা, বাবা, ভাই, চাচা সবাই কান্নাকাটি করছিলেন। আমি ভাবছিলাম, আমি মারা গেলেও তাঁরা যেন বেঁচে থাকে। আমার মা-বাবা সেনাদের পায়ে পড়ে আমার প্রাণ ভিক্ষা চান।’ তিনি বলেন, এক সেনা তাঁদের চুপ করতে বলে ঘরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তাঁরা ঘরে যাওয়ার চার-পাঁচ মিনিট পর সাকা চৌধুরী ও পাকিস্তানি সেনারা তাঁর চাচা ডা. মাখনলাল শর্মাকে ঘর থেকে টেনে উঠানে নিয়ে আসে। এ সময় তাঁর বাবা-মা-ভাই আবার বাইরে এসে কান্নাকাটি করতে থাকেন। সেনারা তখন তাঁদের সারি করে দাঁড়াতে বললেও কেউ সেভাবে দাঁড়াননি। অবশ্য পরে তাঁরা ক্ষতির চিন্তা করে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান। সাকা চৌধুরীসহ পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ১৫ হাত দূরে গিয়ে বসতে বলে। উঠানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে তারা ব্রাশফায়ার করার প্রস্তুতি নেয়। ব্রাশফায়ারের আগমুহূর্তে তিনি (নির্মল) কাত হয়ে পড়ে যান। দুবার ব্রাশফায়ার করা হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি উঠে দেখেন, সাকা চৌধুরীসহ পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব দিকে চলে যাচ্ছে।
জবানবন্দির এ পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাক্ষী নির্মল। কিছুক্ষণ পর আবেগ সামলে তিনি বলেন, তিনি ওঠার পর দেখেন, তাঁর মা পঞ্চবালা শর্মা মারা গেছেন, তাঁর পেটের বাঁ দিকে গুলি ঢোকায় নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। গুলিতে ভাগনে দুলাল শর্মারও নাড়িভুঁড়িও বের হয়ে গেছে। ছোট ভাই সুনীল শর্মা ও চাচা জ্যোতিলাল শর্মাও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মাথায় গুলিবিদ্ধ কাকা ডা. মাখনলাল শর্মা কয়েক দিন পর মারা যান। কেবল তাঁর বাবা বেঁচে ছিলেন, তবে তাঁর বাঁ হাত গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়, বাঁ ঊরুতে গুলি লেগে হাড় ভেঙে যায়।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী আরও বলেন, গুলির শব্দে তাঁর মেজো ভাই বিমল শর্মা এসে অবস্থা দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। পরে তাঁরা দুই ভাই হালদা নদী পার হয়ে হাটহাজারীর গুরদুয়ার গ্রামে চলে যান। সন্ধ্যার পর তাঁরা বাড়ি ফেরেন। রাত সাড়ে আটটা-নয়টার দিকে তাঁরা তাঁদের বাড়ির উত্তরে আলী চৌধুরীর বাড়িতে রাতের জন্য আশ্রয় নেন। খুব সকালে ওই বাড়ির দানু চাচা তাঁদের ডেকে উঠিয়ে দুজনের মাথায় টুপি পরিয়ে দেন এবং একটি কলেমা শিখিয়ে দিয়ে বলেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন বলেন নামাজ পড়তে যাচ্ছেন।
সাক্ষী এ সময় শিখিয়ে দেওয়া ওই কলেমা পাঠ করলে আসামিপক্ষ আপত্তি জানিয়ে এই অংশ জবানবন্দি থেকে বাদ দেওয়ার আরজি জানায়। ট্রাইব্যুনাল কারণ জানতে চাইলে সাকা চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, একজন অমুসলিমের কলেমা পড়ার বিষয়টি জবানবন্দিতে রাখতে যদি ট্রাইব্যুনালের রুচিতে না বাধে, তবে তা রাখতে পারেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা সাক্ষীর বক্তব্য হুবহু রাখার আরজি জানান। এরপর ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামিপক্ষের আপত্তিসহ এটি রাখা হবে।
জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে নির্মল বলেন, টুপি পরিয়ে ও কলেমা শিখিয়ে দানু চাচা তাঁদের দুই ভাইকে রাঙামাটি সড়ক পার করিয়ে দেন। তাঁরা সেখান থেকে রামগড়ের সাবরুম ও পরে আগরতলা যান। ২০-২৫ দিন শরণার্থী শিবিরে ছিলেন। সেখান থেকে তিনি ১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাড়ি আসার পর তিনি চাচা সাধনের কাছে শোনেন, নিহত স্বজনদের শীলপাড়া বড় পুকুরের পাড়ে দুটি গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এ সময় নির্মল আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমার কষ্ট যে আমি ছেলে হয়ে তাঁদের মুখাগ্নি করতে পারিনি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও করতে পারিনি।’
জেরা: জবানবন্দি শেষে মধ্যাহ্ন বিরতির পর নির্মলকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আহসানুল হক। বর্তমান সরকারের সময় সাক্ষী এজিপি (সহকারী সরকারি কৌঁসুলি) হয়েছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে নির্মল বলেন, না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভাই ও মায়ের মৃত্যু সনদ নিয়েছিলেন কি না—এর জবাবেও তিনি বলেন, না।
একপর্যায়ে আহসানুল বলেন, জবানবন্দিতে উল্লিখিত দানু চাচা ও সালাউদ্দিন কাদেরের বাড়ি একই। সাক্ষী বলেন, একই বাড়ি নয়, তবে কাছাকাছি। ওনারা পরস্পর আত্মীয় কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জানা নেই। ভাই বিমল শর্মার সঙ্গে সাক্ষীর সম্পর্ক কেমন—এ প্রশ্নের জবাবে নির্মল বলেন, বর্তমানে ভালো না।
আইনজীবী মত (সাজেশন) দেন, বিমল কোনো দিন ভারতে যাননি। সাক্ষী বলেন, এটি সত্য নয়। আইনজীবী বলেন, সাক্ষীর ভাই সুনীল আদৌ নিহত হননি, তিনি সাক্ষীর সঙ্গে ভারতে চলে যান, আর ফেরেননি। সাক্ষী বলেন, এটিও সত্য নয়।
বিকেলে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় এই মামলার কার্যক্রম আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ১৫ জুলাই: একই ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্যের জন্য ১৫ জুলাই দিন পুনর্নির্ধারণ করেন। আসামিপক্ষের মুলতবি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল গতকাল এ আদেশ দেন।

No comments

Powered by Blogger.