বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা নিজেরা কাঁদলেন, কাঁদালেন সবাইকে-জাতির জনকের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান

“আমাদের দু’বোনের জীবনটাই অসমাপ্ত। ধর্মে আছে কারোর বাবা-মা, ভাই-বোন মারা গেলে কবর দেয়ার আগে মুখ দেখানো হয়, দোয়া-দরুদ পড়তে, আমরা দু’বোন সেই সুযোগটাও পাইনি। এজন্য যতদিন বেঁচে থাকব আমাদের জীবনটা অসমাপ্তই থেকে যাবে। একদিনে সব হারানোর কষ্ট-বেদনা যে কত কঠিন....।”


পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাক্যটি শেষ করতে পারেননি বাকরুদ্ধ কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। দু’চোখ দিয়ে সেসময় ঝরছিল অশ্রুধারা। ছোট বোনের এমন আবেগঘন পরিস্থিতির সময় প্রধান অতিথির আসনে স্থির বসে থাকতে পারেননি বড়বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজ আসন থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরেন শেখ রেহানাকে। বঙ্গবন্ধুর জীবিত এই দু’কন্যা যখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারের পরিবেশ ছিল থমথমে। মর্মস্পর্শী এ দৃশ্য দেখে হলভর্তি হাজার হাজার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষও জড়িয়ে পড়েন আবেগে।
সোমবার অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নিজেরা কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন সবাইকে। আবেগেজড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জনগণের সম্পদ বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী জনগণের মাঝে তুলে দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের পিতা এটা ঠিক। কিন্তু তিনি তো শুধু আমাদের নন, ছিলেন জনগণের সম্পদ। তাই জনগণের সম্পদ জনগণের মাঝে তুলে দিলাম।
বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি সবাইকে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা আরও বলেন, পিতার নিজ হাতে লেখা পা-ুলিপি যখন প্রকাশকের হাতে তুলে দেই, তখন মনে হয়েছে নিজেদের সবচেয়ে বড় সম্পদ যেন তুলে দিলাম। পা-ুলিপিতে যখন হাত বুলিয়েছি তখন যেন বাবারই পরশ পেয়েছি। একজন মানুষ একটি দেশ ও জাতির জন্য যে কতটা আত্মত্যাগ করতে পারে, এই বইটি পড়লে সবাই বুঝতে পারবে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, স্মৃতির পাতা থেকে এবং চীন ভ্রমণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা ডায়েরিগুলোও পর্যায়ক্রমে বই আকারে প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মা বঙ্গবন্ধুকে ডায়েরি লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু আজ তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হলেও মা তা দেখে যেতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রী গ্রন্থটি প্রকাশনা কাজে সহায়তার জন্য সাংবাদিক বেবী মওদুদ এমপিসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগ এ প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঐতিহাসিক এই গ্রন্থটি প্রকাশে সহায়তার জন্য মিলনায়তনে উপস্থিত সবাই নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে এক মিনিট হাততালি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বইটির প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ছাড়াও একইসঙ্গে ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা গ্রন্থটির একাধিক কপি শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন।
ওয়ামী লীগ সভাপতিম-ীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখক অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, বেবী মওদুদ এমপি, গ্রন্থটি ইংরেজীতে অনুবাদকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ফখরুল আলম এবং গ্রন্থটির প্রকাশক স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএলের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং গ্রন্থটির বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা আত্মজীবনীর উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠ করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নূহ-উল-আলম লেনিন ও সহ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান ও কবিতার সমন্বয়ে আয়োজন করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্ব। এতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও কবিতা আবৃত্তি করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলো পরিবেশন করেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী, সুবীর নন্দী, অদিতি মহসিন, তিমির নন্দী, কিরণ চন্দ্র রায়সহ রেডিও ও টেলিভিশনের শিল্পীবৃন্দ।
বক্তব্য রাখতে গিয়ে আবেগ জড়িত কণ্ঠে শেখ রেহানা বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী জনগণের মাঝে তুলে দিতে পেরে আমি আনন্দিত। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে অশ্রু-বেদনা ছাড়া আমাদের আর কিছুই ছিল না। দেশেও ফিরতে পারছিলাম না। একদিনে বাবা-মা, ভাইসহ সব হারানোর বেদনা যে কত কঠিন তা আমরা বুঝি। অনেক সময় আমরা দু’বোন নিজেদের জড়িয়ে কেঁদেছি। আমাদের স্বপ্ন একটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা আর জনগণের কল্যাণে কাজ করা।
তিনি বলেন, জন্ম থেকেই দেখে এসেছি বেশিরভাগ সময়ই বাবা জেলে। জেলে বসেই বাবা অনেক কিছু লিখতেন। আর আমার মা অত্যন্ত যতœ সহকারে রেখে দিতেন। তাঁর নিজ হাতে লেখা একদিন ইতিহাসের একটি অনন্য দলিল হবে তা আগে বুঝতে পারিনি। তিনি বলেন, আমার বাবা বঙ্গবন্ধু সারাজীবনই দেশ ও মানুষের জন্য কষ্ট করে গেছেন। এই গ্রন্থের প্রতি পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধুর সাদাসিধে পথচলার চিত্র উঠে এসেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করলেও নীতিতে ছিলেন অটল, অবিচল। তাই বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনী বাঙালী জাতির সংগ্রামী ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে, নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে পথচলার সাহস ও প্রেরণা যোগাবে।
বুদ্ধিজীবী মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সান্নিধ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ার অজ পাড়াগাঁর মাটি থেকে উঠে এসে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সমাপ্ত আত্মজীবনী পাওয়া গেলে তা বিস্তারিতভাবে নতুন প্রজন্ম জানতে পারত।
সৈয়দ শামসুল হক বঙ্গবন্ধু নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠের আগে বলেন, সাহিত্যচর্চার এই দীর্ঘ জীবনে অনেক আত্মজীবনী প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়েছি, কিন্তু এমন হিমালয়সম মহামানবের সত্যনির্ভর আত্মজীবনী অনুষ্ঠান কখনও দেখিনি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার জন্যই আমরা ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদটি পেলাম। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর এই প্রন্থটি বিশ্বের ইতিহাসে একটি অনন্য দলিল হয়েই থাকবে।
বইটির সম্পাদনা ও গ্রন্থ আকারে প্রকাশের মূল ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিক বেবী মওদুদ এমপি বলেন, যক্ষের ধনের মতো শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা পা-ুলিপিটি সংগ্রহে রেখেছিলেন বলেই এই ঐতিহাসিক দলিলটি জনগণের সামনে বই আকারে প্রকাশের সুযোগ হয়েছে। মুখের কথা এত প্রাণবন্ত ও জাদুকরী প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা ডায়েরিগুলো না দেখলে বোঝা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কত বড় স্পষ্টবাদী, সত্য, বিনয়ী ও দৃঢ়চেতা নেতা ছিলেন তা এই বইটি পড়লেই বোঝা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.