নিত্যপণ্যের বাজার-রমজানের আগেই বাজার চড়া by আবুল হাসনাত

রমজানে কম দামে পণ্য খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কোনো নিত্যপণ্যের দামই ক্রেতার হাতের নাগালে নেই। শবে বরাতের ঠিক আগে এক দফা বাড়ানোর পর চার দিনের মধ্যে আরেক দফা বেড়েছে পণ্যের দাম।
কয়েক বছর ধরেই দাম বাড়ানোর কাজটি রমজানের আগেই সেরে নেওয়ার কৌশলে ব্যবসায়ীরা এবারও সফল হলেন।


আর এর সত্যতা নিশ্চিত করছে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওয়েবসাইট। সেখানে দেখা যায়, মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় থাকা পণ্যের দীর্ঘ সারি। ব্যবসায়ীরা একদিকে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে দাম বাড়ানো হবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন সরকারকে। বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং নামেই, কোনো কার্যকারিতা নেই।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষুব্ধ একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক রহমত আলী গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের কথামতো যদি সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে দাম কমবে কীভাবে?’ রাজধানীর পলাশী বাজারে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।
দাম নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ হিসেবে টিসিবি খোলা ট্রাকে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেছে। আবার বাজারে যখন প্রতি কেজি চিনি ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, তখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) চিনি বিক্রি শুরু করেছে প্রতি কেজি ৬০ টাকা। এ কারণে পাইকারি বাজারে চিনির দাম বেড়ে গেছে কেজিতে দুই টাকা।
বেলা ১১টার দিকে কাঁঠালবাগানে ওএমএসের ট্রাক থেকে ২৪ টাকা দরে ১০ কেজি চাল কিনেছেন দিনমজুর আবদুস সালাম। অন্য জায়গা থেকে কিনলে তাঁর কেজিতে পাঁচ টাকা বেশি দিতে হতো। তিনি বলেন, ‘অন্য জিনিসের যে দাম, পোষায় না। এহান থিকা কয়ডা ট্যাকা কম দিয়া চাইল কিনা যায়। লাভই হয়।’
টিসিবির ট্রাকে সাড়া, বাজারে প্রভাব নেই: রাজধানীর ২৫টি স্থানে খোলা ট্রাকে করে সয়াবিন তেল, চিনি, ছোলা ও মসুর ডাল বিক্রি করছে টিসিবি। শান্তিনগর, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ কয়েকটি স্থানে টিসিবির ট্রাকে মানুষের বেশ সাড়াও পড়েছে। অনেক সচ্ছল ক্রেতাকেও ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে দেখা গেছে।
তবে টিসিবি যে চার পণ্য বিক্রি করছে, তার মধ্যে কেবল চিনিই বাজারে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। অন্য পণ্যগুলো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না টিসিবির কার্যক্রম।
টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর রমজানে টিসিবির হাতে পণ্য মজুদ ছিল চাহিদার ৩ থেকে ৪ শতাংশ। এবার তা ৫ শতাংশ হবে। এই পণ্য দিয়ে হয়তো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তবে ব্যবসায়ীরা যেন দাম বাড়াতে না পারেন, তার ওপর প্রভাব ফেলা সম্ভব হবে।’
চিনির দাম বাড়াল সরকার: খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা। এই অবস্থায় বিএসএফআইসি ৬০ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি শুরু করেছে। আবার টিসিবি তার ডিলারদের পণ্য দিচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে।
দুটি সংস্থার নেওয়া পদক্ষেপের কারণে এরই মধ্যে পরিশোধনকারী মিলমালিকেরা চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিন-চার দিন আগেও রাজধানীর মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের মিলগেট থেকে চিনি দেওয়া হয়েছে ৪৮ টাকা কেজি দরে। বৃহস্পতিবার থেকে মিলগেটে চিনির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতি কেজি চিনির জন্য নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা ৫০ পয়সা, যদিও খুচরা বাজারে এখনো এর প্রভাব পড়েনি।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির সচিব ফেরদৌস বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের চিনির উৎপাদন ব্যয় প্রতি কেজিতে ৮০ টাকা পড়ে। এই চিনি ৬০ টাকাও যদি বিক্রি না করি, তাহলে অনেক লোকসান হয়ে যাবে।’
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নাই। বাজারদর সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই। এর সুযোগ নিচ্ছেন মিলমালিকেরা।’ চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত রমজানের মতো এ দুটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
ভোজ্যতেলের দাম আবারও বেড়েছে: খোলা সয়াবিন তেলের দাম মাস খানেক ধরে ১১৮ থেকে ১২০ টাকা লিটার বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১২২ টাকায়। লিটারপ্রতি বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৮ টাকা লিটার।
এ ছাড়া প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৩৫ এবং পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ টাকায়। অবশ্য চট্টগ্রামভিত্তিক দু-একটি পরিশোধনকারীর পাঁচ লিটারের বোতলজাত তেল ৬৬৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ এখন। কিন্তু রমজানে চাহিদা এর চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। সে অনুযায়ী সরবরাহ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা বলেন, চট্টগ্রামভিত্তিক দুটি পরিশোধনকারী কারখানা থেকে তেল উত্তোলনের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে টাকা দেওয়া হলেও এখনো সেই তেল সরবরাহ করা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রসুন-পেঁয়াজ-আলুর উল্লম্ফন: সব ধরনের রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা। চার দিন আগে এক কেজি দেশি রসুন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। একইভাবে চীনা রসুনের দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা।
বুধবার দেশি পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৮ থেকে ৩২ টাকা। গতকালকের দর ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ২২ থেকে ২৪ টাকার ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ টাকায়। দেশি ও চীনা আদার দামও ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি।
গত বছর আলুর কেজি ছিল ১০ থেকে ১২ টাকা। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৬ টাকায়। অথচ বুধবার আলু বিক্রি হয় ২২ থেকে ২৪ টাকায়।
ডাল-ছোলার বাজার অস্থির: রাজধানীতে ভালো মানের মিয়ানমারের ছোলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। অস্ট্রেলিয়ার ছোলা ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি। অথচ, চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার ছোলার প্রতি কেজি আমদানি মূল্য গড়ে ৫৩ টাকা।
এ ছাড়া প্রতি কেজি মসুর ডাল (ছোট দানা) ১১০ থেকে ১১৫ টাকা, বড় দানার ডাল ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুগ ডাল (ছোট দানা) ১১০ থেকে ১১৫ টাকা, বড় দানার ডাল ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খেসারির ডালের কেজি এখন ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা।
সবজির বাজার গরম: কয়েক দিন ধরেই সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। বেশি বেড়েছে কাঁচা মরিচের দাম। ১০ দিন আগেও ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হওয়া এক কেজি মরিচের দাম এখন নেওয়া হচ্ছে বাজারভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, এক মাসে কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে ১৯১ শতাংশ।
আবার বুধবার প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। গতকালকের দর ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। গত চার দিনে বাজারে অন্য সব সবজির দামই কেজিপ্রতি দুই থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে।
দেওয়া হচ্ছে না রসিদ: রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, নিউমার্কেট ও পলাশী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারের অর্ধেকেরও বেশি দোকানে মূল্যতালিকা টাঙানো হয়েছে। কোনো কোনো দোকানে দেখা গেছে হাতে লেখা মূল্যতালিকা।
হাতিরপুল বাজারে ভেতরের একটি দোকানে মূল্যতালিকা না দেখে কারণ জিজ্ঞেস করতেই দোকানি বলেন, ‘গতকাল টাঙাই ছিলাম। আজকে টাঙাইতে ভুইল্যা গেছি।’ এই বলে তিনি মূল্যতালিকা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক নির্দেশনা অনুযায়ী পণ্য বিক্রিতে পাকা রসিদ ব্যবহার করছেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা। এর বদলে সাদা কাগজে পণ্যের বিবরণ ও দাম লিখে ক্রেতাদের দিচ্ছেন তাঁরা। তাতে দোকানের নাম লেখা থাকছে না।
অভিযানের কথা আগেই জানছে বাজারগুলো: সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীরা এখন আগেই অভিযানের খবর পেয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে কখন কোন বাজারে অভিযান করা হবে, তা আগেই সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে আগেই প্রস্তুতি সেরে ফেলছেন দোকানিরা।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। বাজার তদারকিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন বিষয়ে আমরা শক্ত অবস্থানে থাকব।’ তিনি জানান, রমজান উপলক্ষে অধিদপ্তর সারা দেশে শতাধিক অভিযান পরিচালনা করবে।
সরকারের তদারকি কেবল নামেই: কয়েক বছর ধরেই রোজার আগে সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবারের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। গত রমজানে ছোলার দাম সর্বোচ্চ হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। কিন্তু এবার রমজানের ২০-২৫ দিন আগেই এই দাম ছুঁয়েছে ছোলা।
নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিন বাড়লেও সরকারের কার্যত কোনো তদারকি নেই। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে বাজার অভিযান আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক—এই দুই কৌশলই জানা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। বাজার তদারকির জন্য ১৪টি টিম করেই মন্ত্রণালয় মনে করছে দাম নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.