শান্তাদের দাম মাত্র ৭৫ ডলার!

শান্তা চৌধুরীর বয়স তখন আট বছর। মাত্র ৭৫ ডলারের বিনিময়ে তাঁকে বিক্রি করে দেন তাঁর মা-বাবা। এত্তটুকুন বয়সে মনিবের ঘরদোর ঘষামাজা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না—সব কাজ সামলাতে হয়। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছোটাছুটি। সব কাজ সেরে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা যখন এলিয়ে দেন, দেখা যায়, দিনের ১৯টা ঘণ্টা পার!


সেদিনের সেই ছোট্ট শান্তাই আজ প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদ। তিনি এখন নেপালের প্রভাবশালী নারীদের একজন। কিন্তু ১৮ বছরের দাসত্ব জীবনের কথা মনে পড়লে এখনো চোখের কোণ ভিজে ওঠে তাঁর। ভোর চারটায় ঘুম থেকে জাগা, পান থেকে চুন খসলেই মনিবের পিটুনি ছিল তাঁর নিয়তি। মনিব কর্তৃক অন্য নারীদের ধর্ষণ আর নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে থাকতে চাইছেন।
শান্তা বলছিলেন, ‘নির্যাতনের সেসব কথা মনে পড়ে যায়। আমার ওজনের চেয়েও ভারী জিনিস বয়ে বেড়াইছি। অসুস্থ হলেও রেহাই ছিল না। অতীত মনে পড়লে বুকটা ফেটে যায়।’ তিনি বলেন, ‘অনেক “কামলারি” (চাকরানি) মনিবের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমি নিজেও তা দেখেছি।’
নেপালের দক্ষিণ-পশ্চিমে সমতলভূমি তরাই অঞ্চলে সরকারিভাবে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে ৯০ বছর। কিন্তু এখনো সেখানে তা টিকে রয়েছে। ‘কামলারি’ হচ্ছে সেই দাসপ্রথারই একটি রূপ, যা দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। অভাবের তাড়নায় এলাকার আদিবাসী থারুরা তাদের মেয়েদের ছয় বছর হলেই উচ্চবর্ণের জমিদার ও দালালদের কাছে বিক্রি করে দেন। এটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসছে।
অথচ এক শতাব্দী আগেও থারু আদিবাসীদের নিজেদের জমিজমা ছিল। তরাই অঞ্চলে তখন একটি সাধারণ রোগ ছিল, ম্যালেরিয়া। তবে থারুদের প্রকৃতিগতভাবে এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা ছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটলে নিরক্ষর আদিবাসীদের তাঁদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে দেয় উচ্চবর্ণের জমিদাররা। সেই থেকে নিজভূমেই ক্রীতদাসে পরিণত হন থারুরা। ঋণে জর্জরিত থারুরা বাধ্য হয়ে তাঁদের মেয়েদের বিক্রি করে দেন জমিদারদের কাছে।
শান্তারা নয় ভাইবোন। ভূমিহীন মা-বাবার কাজেরও সুযোগ ছিল না। তাই বছরে মাত্র ছয় হাজার ৬০০ রুপি (৭৫ ডলার) চুক্তিতে শান্তাকে এক জমিদারের কাছে বিক্রি করে দেন তাঁরা। ২০০৬ সালে নেপালের সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশ বলে দাসত্বের কবল থেকে মুক্তি পান শান্তা (৩২)। আদালত কামলারি প্রথাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে রায় দেন।
শান্তা এখন আদিবাসীদের ভূমি ফেরত চেয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যোগ দিয়েছেন ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট পার্টিতে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে তাঁকে পার্লামেন্টে একটি আসন দেওয়া হয় (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার আওতায়)। শান্তা বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাও মানবাধিকার কর্মীদের বাড়িতেও শিশুশ্রমিক রয়েছে। আমরা যে পর্যন্ত না এসব বাড়িতেও অভিযান চালাতে পারছি, এ সমস্যার সমাধান হবে না।’ এএফপি।

No comments

Powered by Blogger.