ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-গণতন্ত্র চর্চার অর্ধেক সুযোগ by শেখ আবদুস সালাম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল বাঙালি জাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় এবং গৌরবদীপ্ত অর্জন; এই ভূখণ্ডে গণতন্ত্র ও সামাজিক অগ্রসরতাকে লালন এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি চমৎকার সুযোগ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের নাগরিকরা প্রথম যেমন রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পায়; তেমনই সৃষ্টি


হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ধারাকে আরও ঐতিহ্যমণ্ডিত করে সামনে এগিয়ে চলার এক মহাসুযোগ। আমাদের জাতির জনকের নেতৃত্বে গঠিত তৎকালীন সরকারের অতি স্বল্প সময়ে প্রণীত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানসহ বহু আইনি কাঠামো। সে দিনের সংবিধানের আলোকেই মানুষের মৌলিক অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় গণতন্ত্রের ধারণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩ [রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১১ (১৯৭৩)]। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের যে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য এ আদেশ একটি অনন্য মডেল। এটি আমাদের স্বাধীনতার একটি উল্লেখযোগ্য ফসল। ১৯৭৩ সালের এ আদেশের ভিত্তিতে আজও ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এর মোটাদাগে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমাংশে ৬১টি আর্টিকেল এবং অন্যাংশ হচ্ছে সাবসিক্যুয়েন্ট অ্যামেন্ডমেন্টসহ ১৩টি স্ট্যাটিউট সম্পর্কিত। সম্প্রতি এ টহরাবৎংরঃু ড়ভ উযধশধ, ঞযব ঈধষবহফধৎ চধৎঃ-১, চৎবংরফবহঃ্থং ঙৎফবৎ ঘড়. ১১ ড়ভ ১৯৭৩ (ঞযব উযধশধ টহরাবৎংরঃু ঙৎফবৎ ১৯৭৩) পাঠ করতে গিয়ে এর আর্টিকেল ৫৬ (২)-এ বর্ণিত নিম্নের অনুচ্ছেদ দুটির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে :
\'ঞযব ংবৎারপব পড়হফরঃরড়হং ংযধষষ নব ফবঃবৎসরহবফ রিঃযড়ঁঃ ধহু ঢ়ৎবলঁফরপব ঃড় ঃযব ভৎববফড়স ড়ভ ঃযব ঃবধপযবৎ ড়ৎ ড়ভভরপবৎ ঃড় যড়ষফ ধহু ঢ়ড়ষরঃরপধষ ারবংি ধহফ ঃড় শববঢ় ধংংড়পরধঃরড়হ রিঃয ধহু ষধভিঁষ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ ড়ঁঃংরফব ঃযব ঁহরাবৎংরঃু ধহফ ংযধষষ নব পষবধৎষু ংঃধঃবফ রহ ঃযব পড়হঃৎধপঃ.
চৎড়ারফবফ ঃযধঃ রভ ধ ঃবধপযবৎ ড়ৎ ড়ঃযবৎ ংধষধৎরবফ বসঢ়ষড়ুবব ড়ভ ঃযব ঁহরাবৎংরঃু ংববশং বষবপঃরড়হ ধং ধ গবসনবৎ ড়ভ চধৎষরধসবহঃ, যব ংযধষষ নবভড়ৎব ঃযব ফধঃব ভড়ৎ ভরষরহম ড়ভ হড়সরহধঃরড়হং, ৎবংরমহ ভৎড়স ঃযব ংবৎারপব ড়ভ ঃযব টহরাবৎংরঃু\'.
স্মর্তব্য যে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েলের (২০০৮ সালে প্রকাশিত) ৩২-৩৬ পৃষ্ঠাগুলোয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা বিধৃত রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১২ অনুচ্ছেদের আলোকে প্রণীত এই ম্যানুয়েলে বাংলাদেশের নাগরিক এবং যার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে তিনি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন। তবে যদি আদালত কোনো ব্যক্তিকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করে, তিনি যদি দেউলিয়া ঘোষিত হন, কেউ যদি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে ফৌজদারি অপরাধে দোষী হয়ে দুই বছরের দণ্ডে দণ্ডিত হন, প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন ইত্যাদি কারণে তিনি নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হবেন। নির্বাচন ম্যানুয়েলের ২। (২) (গ) অনুচ্ছেদে সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো লাভজনক পদ বলতে সরকারি সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ বা 'সরকারের ৫০%-এর অধিক অংশীদারিত্ব সম্পন্ন কোনো কোম্পানিতে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত কোনো পদ বা অবস্থান'কে বোঝানো হয়েছে। একই ধারার (জ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের কোনো চাকরিতে চুক্তিভুক্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং ওই মেয়াদ অতিক্রান্ত বা চুক্তি বাতিলের পর তিন বছর অতিবাহিত হয়নি' এমন ব্যক্তি সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন না। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ২ মার্চ ২০১১ তারিখের একটি পরিপত্রে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সংক্রান্ত ৩ (ছ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেউ সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে এবং তা গৃহীত হলে নির্বাচন করিতে পারিবেন।' উল্লেখ্য, এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের চাকরিস্থলে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে কিংবা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
১৯৭৩-এর আদেশ দ্বারা পরিচালিত ঢাকাসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে_ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ কি-না? সেখানে চাকরিরত শিক্ষক-কর্মকর্তারা লাভজনক পদধারী কি-না? এবং চাকরি ত্যাগ কিংবা অবসর গ্রহণের পরে নির্বাচন করার জন্য তাদের ক্ষেত্রেও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে কি-না? এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, ১৯৭৩ সালের আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাংলাদেশের যে কোনো বৈধ রাজনৈতিক দলের সমর্থক, সাধারণ সদস্য এমনকি কার্যনির্বাহী নিযুক্ত হয়ে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন; কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। দেশের রাজনীতিক এবং সমাজসচেতন সৎ, শিক্ষিত ও দেশপ্রেমী মানুষরা বিশেষ করে জাতীয় রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সংসদে অবদান রাখবেন এটাই সাধারণভাবে সবার প্রত্যাশা।
ভারত উপমহাদেশে সেই ঔপনিবেশিক আমলেও সেসব শীর্ষ রাজনীতিক যেমন জওহরলাল নেহরু, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক_ তারা সবাই ছিলেন শিক্ষার আলোকে আলোকিত মানুষ; প্রথিতযশা আইনজ্ঞ। অধ্যাপক রওনক জাহানের একটি গবেষণায় দেখতে পাই, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭০ এমনকি ১৯৭৩ সালেও জাতীয় সংসদে আইনজ্ঞ এবং শিক্ষিতজনরা বৃহত্তম সংখ্যায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের সংসদে নির্বাচিত (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) এবং নির্বাচনগুলোয় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সামাজিক-রাজনৈতিক এবং একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড তেমন সুখকর নয়। এসব ব্যক্তির বৃহদাংশের অর্থনৈতিক দাপট নিয়ে কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। অনুমান করা যায়, আমাদের দেশে এখন শক্তিশালী অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডসম্পন্ন ব্যক্তিরাই বরং গোটা রাজনীতি তথা সংসদ এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিষয়টি সম্পর্কে আরও কিছুটা সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য আমি অধ্যাপক ড. শফিক সিদ্দিক রচিত 'নকশাল, বাকশাল, টাকশাল' বইটি পাঠ করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বা রাজনীতি করতে আগ্রহী (যা আইন কিংবা ১৯৭৩-এর আদেশ এবং নীতি-নিয়ম দ্বারা স্বীকৃত) আমি মনে করি সে ক্ষেত্রে তাদের জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা রাজনীতি করেন তাদের 'রাজনীতিবাজি করার' অভিযোগ এনে অনেক সময় অপবাদ দেওয়া হয়; কিন্তু রাজনীতি করে যেখানে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে (যেমন_ সংসদে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া) সেখানে তাদের অংশ নিতে এই আদেশের দ্বারা বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার বিবেচনায় ১৯৭৩-এর আদেশ অনুযায়ী যেহেতু তারা শিক্ষক থাকা অবস্থায় রাজনীতি করতে পারেন_ রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন; তাহলে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করারও সুযোগ দেওয়া উচিত। হতে পারে তিনি নির্বাচিত হলে শপথ নেওয়ার আগে বা পরে চাকরি ছেড়ে দেবেন। কারণ তখন তার পক্ষে আর বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণকালীন সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।
উল্লেখ্য, পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আমাদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আদেশ এবং আইনের প্রায়োগিক দিকটি আমার কাছে অনেকটা এমন মনে হয়েছে যে, 'একজন ব্যক্তিকে পুকুরে নেমে গোসল করতে অনুমতি দেওয়া গেল কিন্তু মাথা ভেজানোর অনুমতি নেই'। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক রাজনীতি করতে পারবেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে পারবেন, মিছিল-মিটিং করতে পারবেন, রাজনৈতিক দলের সদস্য এমনকি নির্বাহী হতে পারবেন, কিন্তু সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয়ভাবে অবদান রাখার সুযোগটুকু তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না। আমি মনে করি, এই নীতি-নিয়মের ফলে জাতি বরং অপেক্ষাকৃত সমাজসচেতন এবং পরিশীলিত মানুষের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 'রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার অর্ধেক অধিকার রয়েছে, আবার অর্ধেক নেই'_ এ রকম একটি নীতির ফলে একজন শিক্ষকের পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি-না তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
এমতাবস্থায় একটি 'টোটাল ডেমোক্রেটিক' দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে [হয় এসব শিক্ষককে পুরো রাজনৈতিক অধিকার প্রদান (রাজনীতি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ দুটিই) অথবা অন্যান্য সরকারি বা আধাসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মতো তিনিও আলাদাভাবে চাকরিকালে কোনো অংশগ্রহণমূলক কার্যকর রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবেন না] বিষয়টি সম্পর্কে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক আদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে চর্চা কিংবা ভোগ করার সুযোগে ব্যত্যয় ঘটানো উচিত কি-না তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে বলে আশা করি।


ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
salam @univdhaka.edu
 

No comments

Powered by Blogger.