মনে করে বিজিএমইএ-মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়লে জন্মহারও বাড়বে! by মানসুরা হোসাইন

মাতৃত্বকালীন সুবিধা ১৬ (৮+৮) সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৪ সপ্তাহ করা হলে তা জন্মনিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে জন্মহার বাড়াতে উৎসাহিত করবে। আবার এ সুবিধা পাওয়ার পর কর্মীদের চাকরিতে ফিরে না আসার প্রবণতাও বাড়বে। দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে শ্রমিকের দক্ষতা হ্রাস পাবে।


বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে এ মতামত দিয়েছে। বিজিএমইএ আরও বলছে, বাংলাদেশে এই ছুটি ১১২ দিনও (পৌনে চার মাস) অত্যন্ত অযৌক্তিক। ভারতের মতো বাংলাদেশেও শ্রম আইনে এই ছুটি ৮৪ দিন (১২ সপ্তাহ) করা বাঞ্ছনীয়।
বর্তমানে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানোর একটি প্রস্তাব শ্রম মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। শ্রম মন্ত্রণালয় সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। তার পরেই সংশোধন হবে শ্রম আইনের। আর এখানেই মতামত দিয়েছে বিজিএমইএ। এর আগে গত ১৬ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও এসব কথা বলেছে বিজিএমইএ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার সরকারি কর্মজীবী নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছে। শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ (এক্সক্লুসিভ) খাওয়ানো নিশ্চিত করে যোগ্য ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরি করাই মূল উদ্দেশ্য। তারই আলোকে শ্রম আইন, ২০০৬-এর সংশোধনীতে এই ছুটির মেয়াদ ছয় মাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে বিজিএমইএর পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আশির দশক থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পোশাকশিল্প মূল্যবান অবদান রেখে আসছে। এই শিল্পের কাজের ধারাবাহিকতার কারণে অনেক নারীশ্রমিক সহজে সন্তান জন্ম দেওয়ার চিন্তা করতেন না।
বিজিএমইএ আরও মনে করে, অফিস-আদালতে কেউ ছয় মাস অনুপস্থিত থাকলে কাজে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু পোশাকশিল্পে ৮০ শতাংশ নারীশ্রমিক কর্মরত, যেখানে কোনো শ্রমিক কোনো পোশাক এককভাবে তৈরি করেন না। শার্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে একটি লাইনের মধ্যে একজন বডি সেলাই, একজন কলার, একজন কাফ, একজন পকেট তৈরিসহ একেকটি কাজ করেন। একটি লাইনের মধ্য থেকে একজন দক্ষ শ্রমিক অনুপস্থিত থাকলে উৎপাদনের মাত্রা অনেক কমে যাবে। এতে উৎপাদন কঠোরভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। শূন্য স্থানে শ্রমিক নিয়োগে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়বে।
বিজিএমইএ আরও বলেছে, মালয়েশিয়ায় ৬০ দিন, ইন্দোনেশিয়ায় ৯০, কোরিয়ায় ৯০, চীনে ৯০, ভারতে ৮৪ ও ফিলিপাইনে ৬০ দিন (অস্ত্রোপচার হলে ৭৮ দিন) মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হচ্ছে। এই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক উন্নত।
শ্রমসচিব মিকাইল শিপার প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পোশাকশিল্পের কথা চিন্তা করে আইনের সংশোধনী হবে না। বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। নারীদের সার্বিক মঙ্গল হয়, সেদিক বিবেচনা করেই আইনের সংশোধনী হবে। আইনের সংশোধনী নিয়ে বিজিএমইএসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই চলছে বলেও উল্লেখ করেন সচিব।
মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়লে জন্মহার বাড়বে—এ প্রস্তাবনা সম্পর্কে মিকাইল শিপার বলেন, ‘এসব হচ্ছে বাজে যুক্তি। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি—যেখানেই কাজ করুক, মা হওয়ার পর আর বিভেদ করার উপায় নেই। সবার প্রয়োজন ও চাহিদা একই থাকে।’
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাকশিল্পের নারী কর্মীরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কাজে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁরা দেরিতে বিয়ে করছেন। মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হলে জন্মহার কীভাবে বাড়বে—এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাকশিল্পের নারীশ্রমিকেরা সন্তান প্রসবের আগে ছুটি নিচ্ছেন। তাই চার মাস বা তার চেয়ে কিছু কম দিনের জন্য যে ছুটি পাচ্ছেন, তা যথেষ্ট। এ ছাড়া বেশির ভাগ কারখানায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আছে। সেই কর্মী চাইলে তাঁর সন্তানকে এই কেন্দ্রে রেখে কাজ করতে পারছেন।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কারখানা আইন অনুযায়ী পোশাকশিল্পের নারী কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিচ্ছে। কিছু কারখানার কর্মীদের এই ছুটি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। তবে কারখানায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের চিত্র ভয়াবহ খারাপ। কিছু কারখানায় দেখানোর জন্য পুতুল, খেলনা—সবই সাজানো থাকে, শুধু সেখানে শিশুরা থাকে না। ফলে নারীদের সন্তানকে গ্রামে নানি, দাদির কাছে রেখে আসতে হয়। এই সন্তানেরা মায়ের বুকের দুধটুকুও খেতে পারে না। এ অবস্থায় আইনের সংশোধনী প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।

No comments

Powered by Blogger.