রেলসেতু যখন মৃত্যুফাঁদ!

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশার ইউনিয়নের কৈডাঙ্গা রেলসেতুটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সেতুর ওপরের অংশের কাঠামোয় ধাক্কা লেগে প্রতিবছর ২০-২৫ জন ট্রেনযাত্রী মারা যাচ্ছে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ছাদে ভ্রমণের সময় অধিকসংখ্যক যাত্রী মারা যাচ্ছে। গত ১০ বছরে এই সেতুতে চার শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।


সিরাজগঞ্জ জিআরপি থানার পরিদর্শক লাইছুর রহমান বলেন, ‘শুধু ওই রেলসেতুতে মৃত্যুর সংখ্যা আলাদা করে আমাদের কাছে নেই। তবে প্রতিবছর আনুমানিক ২০ জন যাত্রী মারা যাচ্ছে। এভাবে গত ১০ বছরে ২০০ জনের মৃত্যু হতে পারে।’ তবে রেলের এই হিসাব মানতে রাজি হননি দিলপাশার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অশোঘোষ। তিনি জানান, তাঁদের হিসাবে গত ১০ বছরে এই সেতুর ওপরের খাঁচায় ধাক্কা লেগে কমপক্ষে ৪৩৯ জন মারা গেছে। উপজেলা পরিষদেও এই হিসাব আছে।
কৈডাঙ্গা নতুনপাড়া গ্রামের আবদুল আলীম ও দিলপাশার গ্রামের মনির খান জানান, জিআরপির হিসাব ঠিক নয়। কারণ তারা ট্রেনের লাইনের ওপরে পড়ে থাকা লাশ নিয়ে যায়। কিন্তু যেসব যাত্রীর লাশ নদীতে পড়ে ভেসে যায় এবং যারা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যায়, সেসব হিসাব তাদের কাছে নেই।
দিলপাশার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অশোক কুমার ঘোষ অভিযোগ করেন, রেল কর্তৃপক্ষ সেতুটি নতুন করে নির্মাণ করতে না পারলেও এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধে সচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে পারে। তারা জিআরপির পুলিশ দিয়ে যাত্রীদের ট্রেনের ছাদে ওঠা বন্ধ করতে পারে। কিন্তু তারা কখনই তা করেনি।
রেলওয়ের পাকশী বিভাগের প্রকৌশলী সেলিম রউফ জানান, ঢাকা-রাজশাহী রেলপথে মোট তিনটি খাঁচা সেতু রয়েছে। এগুলো ব্রিটিশ আমলে তৈরি। এর মধ্যে কৈডাঙ্গা রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট এবং প্রস্থ ১৪ ফুট ২ ইঞ্চি। এর নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত লোহার খাঁচা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। সেতুটির উচ্চতা ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি। অপর সেতুগুলোর তুলনায় এই সেতুর উচ্চতা ১ ফুট ৭ ইঞ্চি কম। এ কারণে ছাদে ওঠা যাত্রীরা সহজেই অন্য সেতুগুলো পার হতে পারলেও এই সেতু পার হতে পারে না। তাই অসাবধানতাবশত যাত্রীদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
বড়াল সেতু স্টেশনমাস্টার আবদুল খালেক জানান, এই সেতুর ওপর দিয়ে দুটি লোকালসহ ঢাকা-খুলনা রেলপথের দুটি, রাজশাহী-ঢাকা পথের তিনটি, নীলফামারী-ঢাকার একটি ব্রডগেজ এবং দিনাজপুর, রংপুর ও লালমনিরহাটে তিন মিটারগেজ ট্রেন চলাচল করে।
ভাঙ্গুড়া রেলস্টেশনের মাস্টার নুরুল ইসলাম বলেন, ব্রডগেজ ট্রেনগুলো অনেক উঁচু হওয়ায় ছাদ ও সেতুর ওপরের অংশের খাঁচার মাঝে ফাঁক থাকে মাত্র আড়াই ফুট। তাই যাত্রীরা বসে থাকলেও আঘাত পায় এবং ধাক্কা লেগে পড়ে যায়।
গত শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙ্গুড়ার বড়াল সেতু স্টেশনের অদূরে শরৎনগর ও দিলপাশার স্টেশনের মাঝখানে গুমানী নদীর ওপর কৈডাঙ্গা সেতুর অবস্থান।
এলাকাবাসী জানান, চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল বিকেলে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দিনাজপুরগামী নীলসাগর ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করার সময় দুজন; ১৪ জুন রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী আন্তনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে ভ্রমণের সময় তিনজন এবং ৫ জুলাই রাতে ঢাকা থেকে খুলনাগামী আন্তনগর চিত্রায় ভ্রমণের সময় একজন যাত্রীর মৃত্যু হয়। সাধারণ সময়ের চেয়ে দুই ঈদের সময় প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে বাধ্য হয়ে সাধারণ যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করছে। এ কারণে ওই সময় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। ২০১০ সালের কোরবানি ঈদের সময় এক দিনে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে সাতজনের লাশ পাওয়া যায়। আর তিনজনের লাশ নদীতে ভেসে যায়।
যাত্রী মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, সেতুগুলো ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। এর গার্ডার (খাঁচা) সরালে ট্রেন ভারসাম্য হারিয়ে সেতু থেকে পড়ে যাবে। তাই এটি সংস্কার ক কুমার করে যাবে না। আর যাত্রীদের ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ না কারাই ভালো।

No comments

Powered by Blogger.