ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা-নিম্ন-আস্থার সমাজে স্বস্তির নির্বাচন

সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনেকগুলো দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম। আবার কোনো দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বপ্রথম সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অবিশ্বাস ও অনাস্থার দৃষ্টিতে নির্বাচনী ফলাফল দেখে থাকে। নির্বাচনে জয়ী হলে বলা হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু


হয়েছে। আবার পরাজিত হলে বলা হয়, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। আমাদের দেশটি যে এখনো নিম্ন-আস্থার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, এটিও তার একটি বড় উদাহরণ। তবে নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টা, সরকারের সহযোগিতা এবং মাঠে শক্ত প্রতিপক্ষ থাকলে যে নির্বাচন অনেকটাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, এবারের পৌরসভা নির্বাচন এবং হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। নবম জাতীয় সংসদের দুজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য আসনে গত ২৭ জানুয়ারি ২০১১ হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষণীয় যে এর আগে গত ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫৯টি পৌরসভায় পর্যায়ক্রমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ায় কিছু বুদ্ধিজীবী ব্যাপক হানাহানির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন অনেকাংশে সংঘাতহীন হওয়ায় তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একইভাবে ওই সংসদীয় শূন্য আসন দুটির নির্বাচনও সংঘাতহীন হয়েছে বলে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সর্বোপরি জনগণ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। তা ছাড়া এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশেও এটি বড় অর্জন হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে বলে আমাদের ধারণা। এবার নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যোগ্য ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষক হিসেবে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সুষ্ঠুভাবে ভোটার তালিকা সরবরাহ করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনকে তাদের ওয়েবসাইট হালনাগাদ করতে দেখা গেছে। তা ছাড়া কমিশন তার নিজস্ব জনবল থেকে ৩৯ ব্যক্তিকে নীরব (সাইলেন্ট) পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করে। এসব ব্যবস্থা প্রয়োগের ফলে নির্বাচন কমিশন তার প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের পথে বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে বলা যায়।
হবিগঞ্জ-১ আসনে মাত্র এক হাজার ২৮৫ ভোট বেশি পেয়ে বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন (উল্লেখ্য, তিনি পঞ্চমবারের মতো চেষ্টা করে এবার জয়ী হয়েছেন)। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া ৮১ হাজার ৩৩০ ভোট পেয়ে প্রথম, আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী ৮০ হাজার ৪৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবদুল মুনিম চৌধুরী ২২ হাজার ২২০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এক লাখ ২৫ হাজার ১৪১ ভোট পেয়ে প্রথম এবং বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার খালিদ হোসেন মাহবুব শ্যামল ৮৪ হাজার ৬৬১ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। ওই দুটি আসনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য জানিপপ দুটি ভ্রাম্যমাণ পর্যবেক্ষণ দল পাঠায়। প্রতিটি দলে পাঁচজন করে সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রথম দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের ১২৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি এবং দ্বিতীয় দলটি হবিগঞ্জ-১ আসনের ১৭৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি কেন্দ্র দৈবচয়ন ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ করে। তারা পর্যবেক্ষিত প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের কর্মরত দেখতে পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের প্রায় সব ভোটকেন্দ্রেই উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্বরত ছিলেন। এ ছাড়া র‌্যাব সদস্যদেরও টহল দিতে দেখা গেছে। তবে নির্বাচন দুটি শতভাগ সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে বলা যায় না। যেমন_ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সদর উপজেলার অন্তর্গত অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে (ভোটকেন্দ্র-৬) ভোট গ্রহণের প্রস্তুতির সময় সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসার জুয়েল নামের এক রাজনৈতিক কর্মীকে কর্তব্যরত পুলিশের সহায়তায় কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার করেন। হবিগঞ্জ-১ আসনের বাহুবল উপজেলার অন্তর্গত পুটিঝুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (ভোটকেন্দ্র-১৫-এর বুথ নম্বর-৩) দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে শরিয়ত উল্লাহ নামের একজন অননুমোদিত ব্যক্তিকে পোলিং এজেন্ট হিসেবে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সদর উপজেলার অন্তর্গত সাবেরা সোবাহান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (ভোটকেন্দ্র-২১-এর বুথ নম্বর-১-মহিলা) ভোট গ্রহণের আগে একজন প্রার্থীর সমর্থক এবং পোলিং অফিসারকে যৌথভাবে ব্যালট বাঙ্ সিলগালা করতে দেখা যায়। একই ভোটকেন্দ্রের একটি বুথে একসঙ্গে তিনজন নারী ভোটারকে ভোট প্রদান করতে দেখা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের পর্যবেক্ষণ করা ভোটকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগ টয়লেট অপরিচ্ছন্ন ও পানিবিহীন ছিল। আবার একই আসনের মাদ্রাসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (ভোটকেন্দ্র-২৯) এবং সাহেরা গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (ভোটকেন্দ্র-২৪) কয়েকটি বুথ দোতলায় স্থাপিত হওয়ায় প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ভোটারদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে (ভোটকেন্দ্র-২) বিকেল ৩টা ৩১ মিনিটে ৫৩ শতাংশ ভোট প্রদান করা হয়। অন্যদিকে ওই সময়ে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত গন্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (ভোটকেন্দ্র-১৬৭) ৫৫ শতাংশ ভোট প্রদান করতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গড়ে ৮৭ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিল, কিন্তু এ দুটি উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। এর কারণ, এ দুটি সংসদীয় উপনির্বাচন এ মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে সারা দেশে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনের আবহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে ভোটাররা ধরেই নিয়েছিল যে এ উপনির্বাচনের ফলাফলের ওপর সরকারে বা ক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিরোধী দলের জোর দাবির পরও সরকার হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ উপনির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করেনি। কিন্তু তার পরও নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে পৌরসভা নির্বাচনের মতো এবারও নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে নীতিগত অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত পৌরসভা নির্বাচনের মতো সে অবস্থান ধরে রাখতে না পেরে কমিশন সরকারের কাছে সেনাবাহিনী নিয়োজিত করার জন্য একাধিকবার চিঠি দিয়েছিল। বলা প্রয়োজন যে পাকিস্তান আমলের প্রায় পুরোটাই এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অনেকটা সময় সামরিক বাহিনীর অধীনে শাসনকাজ পরিচালিত হয়েছে। দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সিভিল সরকারের সহায়তায় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এ কারণে অনেকেই সেনাপ্রীতি কিংবা সেনাভীতি কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু পরিণামে এটি রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে আস্থার পরিবর্তে অনাস্থাই বৃদ্ধি করে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীন দেশে কয়েকটি নির্বাচিত সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে অনীহা প্রকাশ করেছিল। যার ফলে মাগুরার উপনির্বাচন, ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন এবং ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের মতো ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনার দায় সে সময়কার নির্বাচন কমিশনারদের নিতে হয়েছে। অন্যদিকে ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক সমাজে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস বেড়েছে বৈ কমেনি। একসময় নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা বলতেন, বাঙ্ বদল করে তাঁকে হারানো হয়েছে। অথবা আগে থেকেই বাঙ্ েজাল ব্যালট রেখে দেওয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে স্বচ্ছ ব্যালট বাঙ্ সরবরাহ করে। সেই সঙ্গে সরকারও ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে। এখন বলা হচ্ছে, তাঁদের পক্ষের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি, তাঁদের এজেন্টদের বের করে দিয়ে অন্য পক্ষের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে বা ভোট গণনার সময় কারচুপি করা হয়েছে ইত্যাদি। এসব অভিযোগের সত্যতা গুটিকয়েক ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও এ কারণে পুরো নির্বাচনী ফলাফল অস্বীকার করা দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। বস্তুত নিম্ন-আস্থার সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা এখনো এ ধরনের আচরণ লক্ষ করছি। তবে আশার কথা, অনেকের কাছেই এসব বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। আমরা দেখি, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নির্বাচনের কয়েক দিন পর ভোট গণনা শুরু হয়। সেখানে কেউ ভোট কারচুপির অভিযোগ করে না এ জন্য যে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্বাচন প্রক্রিয়াটি আস্থার মধ্যে আনা সম্ভব হয়েছে। আগামীতে দেশব্যাপী ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট প্রদান করার নিয়ম চালু হলে তখন হয়তো এ রকম অবিশ্বাস-অনাস্থার সংস্কৃতি থাকবে না। তবে অনেকে সন্দেহ করেন, যাঁরা গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা হয়তো ভিন্নভাবে কারচুপির অভিযোগ তুলবেন। অর্থাৎ সব সময়ই নেতিবাচক কথা বলার জন্য কেউ না কেউ থাকবেনই।

লেখকবৃন্দ : যথাক্রমে চেয়ারম্যান, জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ); ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার, জানিপপ; এবং ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার, জানিপপ

No comments

Powered by Blogger.