এমসি কলেজ অনির্দিষ্টকাল বন্ধ, ১৫ শিবিরকর্মী আটক

ছাত্রাবাসে ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট নগরের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।


কমিটির প্রধান করা হয়েছে উপাধ্যক্ষ আল হেলাল ভূঁইয়াকে। কলেজের অধ্যক্ষ ধীরেশ চন্দ্র সরকার একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
এদিকে ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়া ও কয়েকজন ছাত্রকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানোর অভিযোগ এনে কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী শওকত হাসান মানিক গতকাল সকালে শাহ পরান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এতে ৩৫ জনকে নাম উল্লেখ করে এবং ৩৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আসামি করা হয়েছে। তারা সবাই শিবিরকর্মী। পুলিশ রবিবার রাতেই ঘটনাস্থল এবং নগরের বিভিন্ন মেসে অভিযান চালিয়ে ১৫ শিবিরকর্মীকে আটক করেছে। উল্লেখ্য, রবিবার সন্ধ্যায় ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রলীগ আগুন দিলে ছাত্রাবাসের ছয়টি ব্লকের চারটি পুরোপুরি এবং দুটি আংশিকভাবে পুড়ে যায়। ৪২টি কক্ষ সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো ৭০টি কক্ষ। তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
অক্ষত কক্ষগুলোতে ব্যাপক লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ছাত্রলীগকর্মী শওকত হাসান মানিকের দায়ের করা মামলায় এমসি কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম মনোয়ার, শিবির নেতা মনজু, ইয়াসিন, জাহাঙ্গীর, রাসেলসহ ৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
কলেজের অধ্যক্ষ ধীরেশ চন্দ্র সরকার সাংবাদিকদের বলেন, এমসি কলেজের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা নজিরবিহীন। একাডেমিক কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজের ক্লাস ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা রুটিন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে।
শাহ পরান থানার ওসি এনামুল মনোয়ার জানান, শওকত হাসান মানিক নামের এক ছাত্রলীগকর্মী গতকাল সকালে একটি মামলা দায়ের করেছেন। এতে ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা শিবিরকর্মী। মামলাটির তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিকে ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করায় ছাত্ররা ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ ও কলেজের নিরাপত্তারক্ষীরা ছাত্রাবাস পাহারা দিচ্ছেন।
সব হারিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্বাক : কক্ষের সব কিছু পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। টেবিল, খাট আর শখের ল্যাপটপের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু মেঝেতে পড়ে থাকা কাঠ-কয়লা হাতড়াচ্ছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছেন নিজের কক্ষের দিকে। অনেকের শিক্ষা সনদ পুড়ে গেছে। তাঁদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। সনদ পুড়ে যাওয়ায় শতাধিক শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
কলেজের পরিসংখ্যান চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী মখলিসুর রহমান আকাশ থাকতেন চতুর্থ ব্লকের ৪০৫ নম্বর কক্ষে। রবিবার সন্ধ্যার পর তাঁদের কক্ষে যখন আগুন দেয় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা, তিনি তখন টিউশন করতে বেরিয়েছেন। মুঠোফোনে আগুন লাগার খবর শুনে হোস্টেলে যখন পৌঁছালেন, ততক্ষণে পুরো হোস্টেল গ্রাস করে নিয়েছে আগুন। আকাশের মতো হোস্টেলের বেশির ভাগ বাসিন্দাই তখন কক্ষে ছিলেন না। খবর পেয়ে ফিরে এসে দেখেন আগুনে পুড়ছে তাঁদের বাসস্থান, সেই সঙ্গে পুড়ছে তাঁদের সার্টিফিকেট, কম্পিউটারের মতো প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ সব কিছু।
আকাশ বললেন, 'টিউশনির টাকা জমিয়ে অনেক কষ্টে একটা ল্যাপটপ কিনেছিলাম। তা ছাড়া ইউরো ফুটবল দেখার জন্য বন্ধুরা মিলে একটা টেলিভিশনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সব পুড়ে গেছে। সব সময় মানিব্যাগ সঙ্গে নিয়ে বের হই, গতকাল (রবিবার) তাও নিইনি। বলতে পারেন, একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।' তবে কলেজ থেকে সার্টিফিকেট তোলা হয়নি বলে কিছুটা স্বস্তিতে আকাশ; যদিও তাঁর রুমমেট কামাল হোসেনের সেই স্বস্তিটুকুও নেই। ১৪ বছরে তিলেতিলে অর্জিত সব সার্টিফিকেট তাঁর চোখের সামনেই পুড়েছে। কামাল বললেন, 'সার্টিফিকেট, ল্যাপটপ ছাড়াও তখন কক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আত্মীয়ের পাঠানো ৫০ হাজার টাকা। এই টাকা নিয়ে আজ (সোমবার) আমার গ্রামের বাড়ি বড়লেখায় যাওয়ার কথা ছিল।'
অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার্থী নুরুল ইসলাম; ফলাফলে এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। নিজেদের চেয়ে তাঁকে নিয়েই বেশি আফসোস হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থী মো. আব্দুস সালাম বলেন, 'নুরুল ভাইয়ের ফল খুব ভালো। এখন পর্যন্ত তাঁর ফল প্রথম শ্রেণী। আগামী মাসের ১৭ তারিখ থেকে তাঁর পরীক্ষা। তাঁর বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।'
নুরুল ইসলাম সন্ধ্যার সময় লুঙ্গি পরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন তাঁদের হোস্টেল গ্রাস করেছে আগুন। বইপত্র, হ্যান্ডনোট তো গেছেই, সেই সঙ্গে পুড়ে গেছে তাঁর শিক্ষাজীবনের সব সার্টিফিকেট। সব হারিয়ে নুরুল মুষড়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, 'দিনের বেলা তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হয়েছে আর সন্ধ্যায় এ রকম একটা ঘটনা ঘটে গেল। আগামী মাসের ১৭ তারিখে পরীক্ষা। কিভাবে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।'
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কক্ষে ঢুকে নিজের সার্টিফিকেট বাঁচাতে পেরেছেন ইসলামের ইতিহাস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান। তিনি বলেন, 'বিকেল থেকেই খেলার মাঠে কয়েকজনকে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখেছি। এই ঘটনা যে এত বড় মোড় নেবে, তা ভাবতেও পারিনি।'
ইতিহাস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রমজান হোসাইন বলেন, 'আমাদের এখন করণীয় কী বুঝতে পারছি না। খাওয়াদাওয়ার কী হবে, থাকব কোথায় কিছুই বুঝতে পারছি না।'

No comments

Powered by Blogger.