পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা by সৈয়দ গোলাম মোরশেদ

উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) ১৪০০ বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করে আসছেন। উম্মতের জন্য এটি একটি উত্তম ইবাদতও বটে। কারণ প্রিয়নবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি সম্মানের সঙ্গে দরুদ ও সালাম পেঁৗছানো আল্লাহপাক উম্মতের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য করে দিয়েছেন।


যারা নবী করিম (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত ও সম্মানের সঙ্গে দরুদ ও সালাম পেঁৗছায় না তাদের নামাজই হয় না। তাই এ দরুদ শরিফকে আল্লাহপাক নামাজের অংশ করে দিয়েছেন। কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র আবির্ভাব ও তিরোধান দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনের মাধ্যমে প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার ব্যাপারে আপত্তি থাকার কথা নয়।
হজরত আবদুল আযীয মোহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) বলেন, 'প্রতিবছর এ ফাকিরের গৃহে দুইবার মজলিস হয়ে থাকে। প্রথমটি আশুরা বা তার দু-এক দিন আগে যাতে ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মহিমা বর্ণিত হয়, যা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ আছে। দ্বিতীয়টি হয় পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে। উভয় মজলিসে অসংখ্য লোকের সমাগম হয় এবং প্রথমে প্রিয়নবী (সা.)-এর উচ্চ মর্যাদা ও মহিমা বর্ণিত হয়। অতঃপর তাঁর জন্মবৃত্তান্ত, মোজেজা, শারীরিক অবয়বের বর্ণনা সংবলিত হাদিস বর্ণিত হয়। অতঃপর ফাতেহা পাঠ হয় এবং তাবারক বিতরণ হয়।
হজরত কেরামত আলী জৈনপুরী (রহ.) তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেন, আমি 'রেসালায়ে মুলাখ্খাস'-এর মধ্যে ২৫ জন আলেম ও ইমামের কার্য ও বাণী দ্বারা এবং নিজ ঊর্ধ্বতন বুজর্গানের ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমালিয়ত দ্বারা কেয়ামকে সাব্যস্ত করেছি। এ 'কেয়াম' তাজিমের কেয়াম বিধায় তা হজরত আয়শা (রা.)-এর হাদিস দ্বারা প্রমাণ করেছি।
হজরত এমদাদুল্লাহ মোজাহের-এ-মক্কী (রহ.) বলেন, 'আমাদের আলেমদের মধ্যে মিলাদ বিষয় নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বহু আলেম যখন এটাকে জায়েজ বলার পক্ষপাতী তখন তা নিয়ে বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই। আমাদের এই সময় (ওই সময়) মক্কা ও মদিনা শরিফের আলেমদের অনুসরণ করা উচিত। (উল্লেখ্য, তখন মক্কা ও মদিনা শরিফে আলোমরা মিলাদ শরিফ উদ্যাপন করতেন)। যদি মিলাদ শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উপস্থিতি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। মিলাদ মাহফিলকে বরকত লাভের উপায় মনে করে আমি প্রতিবছর মিলাদ মাহফিল উদ্যাপন করে থাকি এবং কেয়াম করে আনন্দ উপভোগ করি।'
হজরত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) তাঁর ফতোয়ায়ে এমদাদিয়ায় ৩২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, 'হুজুর পুর-নূর (সা.)-এর বেলাদত শরিফ (জন্মবৃত্তান্ত) বর্ণনা করার জন্য মাহফিল করা মোস্তাহাব, এতে কেয়াম করা কুফুরি নয়।'
নবী করিম (সা.) উম্মতের গুনাহখাতাও মাফের অবলম্বন হতে পারেন; কারণ আল্লাহপাক তাঁকে সে ক্ষমতা দান করেছেন। দেখুন পবিত্র কোরআনের আয়াত_'হে রাসুল (সা.), আপনি ওদের সম্পদ থেকে ছদকা (নজরানা) গ্রহণ করুন এবং এ দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করুন এবং তাদের জন্য দোয়া করুন। আপনার দোয়া ওদের জন্য সান্ত্বনা ও আল্লাহ তা কবুল করবেন। আল্লাহ সব শোনেন এবং জানেন (সুরা তাওবা : ১০৩)।
হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, এক গ্রাম্য আরব যখন এ আয়াত সম্পর্কে অবগত হলেন, তিনি রাসুল (সা.)-এর শাফায়াতের উদ্দেশ্যে দৌড়ে মদিনা শরিফে এলেন। এসেই মসজিদে নববীতে প্রিয়নবীকে (সা.) খুঁজতে লাগলেন। তিনি জানতে পারলেন যে কিছুদিন আগে নবীজি (সা.)-এর ওফাত হয়ে গেছে। তিনি নবী করিম (সা.)-এর মাজার শরিফ জিয়ারত করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, 'ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমি তো পবিত্র কোরআনের শাফায়াতের এ আয়াত শুনে অত্যন্ত আশা নিয়ে আপনার দরবারে এসেছি আমার জীবনের সব গুনাহখাতা মাফ করিয়ে নেব বলে। কিন্তু আমি বড়ই হতভাগ্য, আপনার সাক্ষাৎ আমি পেলাম না। আমি এখন নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।' অত্যন্ত ভগ্ন হৃদয়ে ওই আরব বেদুঈন ফিরে যাচ্ছিলেন। মসজিদে রাসুল (সা.)-এর একজন সাহাবা ঘুমিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁকে (স্বপ্নে) ডাক দিয়ে বললেন, 'ওহে, আমার ওই উম্মত ভগ্ন হৃদয়ে আমার দরবার থেকে ফিরে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে বলো, নবীজি (সা.) তোমার ফরিয়াদ শুনতে পেয়েছেন এবং তিনি তোমাকে এ সুসংবাদ দিচ্ছেন যে তোমার অতীতের সব গুনাহখাতা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিয়েছেন এবং তোমার আবাসস্থল হবে জান্নাত।'
আজকাল আমাদের দেশে আলেম নামধারী কিছু লোক পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনের বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই গরিব-মিসকিনের জাকাত ফান্ড থেকে টাকা আত্মসাৎকারী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। বাংলাদেশ সরকার সূচনালগ্ন থেকেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করে আসছে। এ দেশের আপামর ধর্মপ্রাণ মুসলমান রবিউল আউয়াল মাস এলেই ঈদের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এমন কোনো অলিগলি নেই, যেখানে আশেকে রাসুলরা (সা.) জাঁকজমক ও আনন্দোৎফুল্লচিত্তে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করেন না। ১২ রবিউল আউয়াল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রতিটি শহরে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রাণপ্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে থাকেন। ওরস-উন-নবী (সা.)-এর মাধ্যমে লাখ লাখ অভুক্ত মানুষকে ভালো খাবার বিতরণ করা হয়। হাজার বছর ধরে উদ্যাপিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এ ইবাদতের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে, যারা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর উদ্যাপনকে 'শিরক-বিদআত' বলে ফতোয়া দেয়, তারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দেয়। আল্লাহ আমাদের নবী করিম (সা.)-এর মহব্বতে জীবন উৎসর্গ করার তৌফিক দিন। কারণ আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন_'আন্নাবীয়্যু আওলা বিল মুমেনিনা মিন আনফুছুহিম'; অর্থাৎ নবী (সা.) মুমিনদের কাছে তাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। (সুরা আহযাব : ৬)

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.