চারদিক-আমরা তো কাঁদছিই by নেয়ামতউল্যাহ

কোকো-৪ লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছিল গত বছর ২৭ নভেম্বর। ২৭ ও ২৮ নভেম্বর লালমোহনবাসী শোক পালন করছে। করছে মানববন্ধন। লালমোহন উপজেলার চর ছকিনা গ্রামে নাজিরপুর খালের তীরে জয়চড়িয়াবাড়ী। চারদিকে সোনালি খেত। জলে পাতিহাঁস দল বেঁধে ডুবসাঁতারে খোঁজে খাবার।


এ খালের তীরে শুয়ে আছেন নবদম্পতি নুরে আলম সোহাগ ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন। তাঁরা দুজনই এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর ঢাকার কর্মস্থল থেকে ফিরছিলেন, বাবা-মা ও ছোট ভাইদের সঙ্গে ঈদুল আজহা পালন করতে। সঙ্গে ছিল ইয়াসমিনের ছোট বোন হ্যাপী। দুই বোনের কেউ আগে লঞ্চে চড়েনি। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহ। ওই বছর বৈশাখে বিয়ে হওয়া দম্পতির মরদেহ যখন লঞ্চের কোটর থেকে উদ্ধার করা হয়, আলিঙ্গনে আবদ্ধ দুজন। হাতে মেহেদি। স্ত্রীর পরনে লাল বেনারসি, স্বামীর প্যান্ট-শার্ট, পরিপাটি দৃশ্য। হূদয়বিদারক দৃশ্য। মা-হারা সোহাগের নতুন মা লালবরু বিবি বলেন, ‘পুতে আমারে হত্ (সৎ) মনে করেনো! যা কামাই কইত্তো, আমগোরে লই খাইতো। হেই পুত আঁর নাই, পুতরে আমি ক্যামনে বুলি (ভুলি) বাইগো...কন!’ সোহাগের বৃদ্ধ বাবা আ. রশিদ এক চোখে দেখেন না। কোকো-৪ লঞ্চডুবিতে ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে ধানের খেত থেকে সোজা দৌড়ে যান লঞ্চঘাটে। তখন ধানের পাতার কাঁটার আঘাতে চোখের মণি নষ্ট হয়ে যায়। পুত্র ও পুত্রবধূর কবর কারা যেন দেখতে এসেছে, শুনেই সেই খেতের মধ্য দিয়ে দৌড়ে আসেন। বলেন, ‘পুতেরে আজাইছি না (হারিয়েছি) সব আজাইছি। এহন আমগোরে দ্যাহোনের কেউ নাই যে কাম-কাইজ করি, চাই-চিন্তি খাই। আমার পুতের লাই আমগোরে দেইখতেন আইছেন, আমি খুশি। আননেরা আমার পুত আর বৌর লাই দোয়া কইর্যেন...।’ এ কথা বলতে বলতে তাঁর কান্নায় দুচোখ ভেসে যায়।
নাজিরপুর খালটি এেঁকবেঁকে মিশেছে তেঁতুলিয়া নদীতে। খাল ও নদীর মোহনায় কিছু দক্ষিণে নাজিরপুর লঞ্চঘাট। এখানেই ডুবেছে কোকো-৪। যদি আজ কেউ নাজিরপুর লঞ্চঘাটে আসেন, তবে দেখবেন, সামনে তেঁতুলিয়া নদী। জলরাশির মাঝেমধ্যে বুকজুড়ে সবুজ-সোনালি ধানখেত। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ডান পাশে চোখের সীমানায় আসে যিশুখ্রিষ্টের বুকে ক্রুশচিহ্নের মতো কিছু। বুঝে নেবেন, এটি কোনো লঞ্চের চিহ্ন। প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন, এটিই এমভি কোকো-৪। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ১১টার সময় এমভি কোকো-৪ লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে নাজিরপুর লঞ্চঘাটেই বাঁ দিকে কাত হয়ে ডুবে যায়।
২০০৩ সালের ৮ জুলাই রাত পৌনে ১১টায় ডুবে যায় মেঘনা-ডাকাতিয়া মোহনায় এমভি নাসরিন। এর ছয় বছর চার মাস ১৯ দিন ১৫ মিনিটের ব্যবধানে ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ১১টায় তেঁতুলিয়া নদীতে ডুবে যায় এমভি কোকো-৪। এ দুটি লঞ্চডুবিতে লালমোহনের এক পরিবারের ২৮ জন সদস্য চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান। হতভাগ্য পরিবারটি ভোলার লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের তোফায়েল পণ্ডিতবাড়ীর। দুই ভাইয়ের দুই ছেলে পারভেজ (১৫) ও লোকমান (২২) জলের থাবা থেকে বাঁচতে পারেননি।
২৪ নভেম্বর সুনসান নীরবতা ভেঙে গজারিয়া বাজারের কাছে তোফায়েল পণ্ডিতবাড়ী যখন পৌঁছলাম, তখন বাড়িতে আছেন শুধু মহিলারা। পারভেজের মা ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছে তাঁর। পারভেজের বাবা আবুল খায়ের লঞ্চডুবির পাঁচ মাস আগেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মা পারুল বিবি ও অবিবাহিত তিন বোনের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন ভাই পারভেজ। সংসারের তাগিদেই ঢাকায় কাজ শিখতে গিয়েছিলেন। এসব কথা শুনলেই মা পারুল বিবি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পারভেজের চাচাতো ভাই লোকমান। তাঁর মা-বাবারও একই অবস্থা। আজ এ পরিবার অভিভাবকশূন্য, এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
পরপর তিনটি মৃত্যুর শোক, সঙ্গে আছে বার্ধক্য, অভাব আর অবিবাহিত দুটি মেয়ের ভবিষ্যৎ। সব মিলিয়ে আয়েশা বানু (৬১) ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতেই পারছেন না। কাছে এসেই হাত-পা ভেঙে মাটিতে বসে পড়লেন। এখনো শোকে পাথর। ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের হাসানগঞ্জের খাঁবাড়িতে আয়েশার বসত। খড়ের তৈরি কুটিরটি বাতাস এসে উড়িয়ে নিতে পারে মুহূর্তে। এক বছর পাঁচ মাস আগে স্বামী কাঞ্চন খাঁ মারা গেছেন। সংসারে আয়ের একমাত্র অবলম্বন ছোট ছেলে কামাল (২০) পাঁচ মাস পরে কোকো-৪ লঞ্চডুবিতে মারা যান। তার এক দিন পরে (২৯ নভেম্বর) নাতির অকালমৃত্যুর শোকে শাশুড়ি মালেকা বেগমও মারা যান। খাঁবাড়িতে ঢুকতে বাঁ দিকে তিনটি কবর সারি করা।
নাসরিন ট্র্যাজেডিতে ৪৪২ জন নিহতের মধ্যে ১২৮ জন নারী এবং কোকো ট্র্যাজেডিতে ৮২ জন নিহতের মধ্যে ৩০ জন নারী স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন।
২৯ নভেম্বর ২০০৯। লঞ্চডুবির তৃতীয় দিন। নাজিরপুর লঞ্চঘাট ময়দান। উপজেলার কালমা দেওয়ানবাড়ীর ১২ জন যাত্রী ঢাকা থেকে আসেন। মনে আছে, স্বেচ্ছাসেবক ছাউনিতে ছোট-বড় অসংখ্য মৃতদেহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই আসছে, মরদেহ শনাক্ত করছে। পরিবারের বড় ভাই মনির হোসেনের (১৩) প্রিয় খেলার সঙ্গী ছোট দুই ভাই রাকিব (৮) ও শাকিব (৭) সেদিন বাঁচেনি। কিন্তু সাত মাসের ছোট বোন সুমা ডুবতে ডুবতেও বেঁচে আছে। তারা এখন ঢাকায় থাকে। তাদের আত্মীয়রা জানান, সুমা এখন মনিরের খেলার সাথি। এটুকুই সান্ত্বনা, সুমা এখন হাঁটি হাঁটি পা পা।
সে যেন আর কোনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চডুবির শিকার না হয়, সেটাই কামনা করে মনির।

No comments

Powered by Blogger.