অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব by কামাল লোহানী

একটি 'আন্তর্জাতিক' সংগঠন- 'ইসলামিক এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন', যাকে আইসেসকো বলা হয়, 'ঢাকা'কে এক বছরের জন্য এ বছর ইসলামিক কালচারাল হেরিটেজ সিটি হিসেবে নাকি নির্বাচিত করেছে এবং জুলাইয়ের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে।


সংবাদটি ১৭ জুন ২০১২ একটি দৈনিকে (সমকাল নয়) পড়ে হতবাক হয়ে গেলাম। শুধু তা-ই নয়, এ উপলক্ষে দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আইসেসকোর কুশলী-কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। বাংলার মানুষের কাছে এই অনুষ্ঠানটিকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য বলা হয়েছে_ অনুষ্ঠানে লালন, হাছন, নজরুলের গান, জারি, সারি ও কবিগানও থাকবে। এরপর সারা বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে 'ইসলামী সাংস্কৃতিক' অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে।
এর কী মাহাত্ম্য, কে জানে? যুদ্ধাপরাধীদের যখন বিচার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে তখনই 'ইসলামিক কালচারাল সিটি' ঘোষণা করে ধর্মীয় জজবা তুলে ইসলামের নামে যারা মানুষ হত্যা, লুটপাট, অপহরণ, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ করেছিল, তাদের বিচার ও শাস্তি ঘোষণার প্রান্তঃসীমায় এ কোন চক্রান্ত? বাংলার সচেতন ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকরা কি এই ঘোষণাকে গ্রহণ করতে পারবে? রক্তাক্ত বাংলার চলি্লশ বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে যারা ইসলাম ধর্মের নাম করে বেধড়ক 'অধর্ম' করেই চলেছে, এ কি তাদেরই উৎসাহিত করবে না?
১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য ডুবে যাওয়ার পর ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান মিলে যে বিদ্রোহ করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, এ কি সেই ঐতিহ্যকে আঘাত করবে না_ যার জন্য আমরা লড়ছি এবং পূর্বপুরুষরা লড়ে গেছেন? আমরা কি ক্ষুদিরাম-তিতুমীর-সূর্য সেন-কাজেম মাস্টারদের বৈপ্লবিক অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত জাতি ছিলাম না? ১৯৫২ সালে এই বাংলায় মাতৃভাষার জন্য নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সুরক্ষার জন্য সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের প্রাণ বলিদানকে একেবারে ভুলে যাব? ভাষাসংগ্রামীরা জীবন দিয়ে নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন, যা কিছু পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আলোকবর্তিকা_ তাই তো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরম আকাঙ্ক্ষিত পরিণতি এবং বাংলাদেশ অর্জন। ১৯৬১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ পালনে সামরিক সরকার বাধা দিয়েছিল,যে বাধা উপেক্ষা করে আমরা সম্মিলিত শক্তি সফল হয়েছিলাম সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলকে কারা 'কাফের' আখ্যা দিয়েছিল?
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টে কবিগুরুকে বলা হয়েছিল 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির অংশ নয়।' কি বিশাল এবং বলিষ্ঠ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল এই দেশ কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসীমউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনদের নেতৃত্বে! সেদিন শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রহরার অস্ত্র নিয়ে তীক্ষষ্ট নজরদারিতে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন। তাই তো আজ 'ছায়ানট'-এর মতো বিশাল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শুধু দাঁড়ায়নি, বঙ্গ সংস্কৃতির লালনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আজ জেলা-উপজেলায়ও রবীন্দ্রচর্চা ছড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় গর্বের ইতিহাস হলো, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ_ যা আমাদের ওই সব সাম্প্রদায়িক চিন্তা, সন্ত্রাস, গুণ্ডামি এবং উগ্র নির্দেশকে গুঁড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আজ চলি্লশ বছর পর এ কোন উদ্যোগ? কারা করছে? কেন এই মোক্ষম মুহূর্ত বেছে নিল এ ধরনের ঘোষণা দেওয়ার জন্য এবং সারা বছর মানে মহাজোট সরকারের শেষ সময়টাই কেন নির্ধারিত হলো এই অনুষ্ঠানমালা করার জন্য?
ঢাকা তো ৪০০ বছরের পুরনো রাজধানী শহর। কত না ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপনা, মসজিদ, মন্দির, গির্জা এই শহরকে উজ্জ্বল করে রেখেছে বিদেশিদের চোখেও। বিশ্ব সংস্থার ইউনেস্কো ইতিমধ্যে ঐশ্বর্য ও ঐতিহাসিক শহর হিসেবে ঢাকাসহ অনেক স্থাপনাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। এতদিন পরে কেন ইসলামী দেশগুলোর সংস্থা 'আইসেসকো' ঢাকাকে হঠাৎ করেই 'ইসলামিক কালচারাল সিটি' বা 'ইসলামী সংস্কৃতির শহর' বলে এক বছরের জন্য জুলাই মাসে ঘোষণা করতে যাচ্ছে? যখন ইসলামী দেশগুলোর মদদে বেড়ে ওঠা ধর্মীয় উন্মাদনা দেশকে এক বিপন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে একজন বয়সী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনির্বন্ধ অনুরোধ_ আপনি যাবেন না এ অনুষ্ঠানে।

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.