সংসদে 'অর্থ বিল ২০১২' পাস-মোবাইল ফোন বিলে কর প্রত্যাহার-* ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ টাকা * ব্যাংকে এক লাখ টাকার বেশি থাকলে টিআইএন লাগবে

মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরোপিত ২ শতাংশ উৎসে কর প্রত্যাহার ও ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ টাকায় নির্ধারণ করে গতকাল বুধবার সংসদে অর্থ বিল ২০১২ পাস হয়েছে। ব্যাংকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে এর সুদ আয় থেকে উৎসে কর কাটা হবে না। তবে এর বেশি থাকলে টিআইএন লাগবে।


বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার কারণে রপ্তানি আয়ে উৎসে কর কমিয়ে ০.৮০ শতাংশ করা হয়েছে। গাড়িতে শুল্কবৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে ১৭৫০ থেকে ২০৫০ সিসি গাড়ির জন্য নতুন শুল্ক স্তর তৈরি করা হয়েছে। এসব সংশোধনী এনে বুধবার রাতে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব দলিল 'অর্থ বিল ২০১২' সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়। ১ জুলাই থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর শুরু হচ্ছে। ওই দিন থেকে এসব সংশোধনী কার্যকর হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে সংশোধনীগুলো উত্থাপন করেন। এর আগে সন্ধ্যায় বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা হবে, এমন কিছু প্রস্তাব সংশোধন করার জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অনুরোধ করেন।
৭ জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেন তাতে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করা হয়। তিনি রপ্তানি আয়ে শুল্কায়নে সমতা আনার জন্য বিদ্যমান ০.৬০ ও ০.৭০ শতাংশের পরিবর্তে উৎসে কর ১.২০ শতাংশ আরোপের প্রস্তাব করেন। মোবাইল ফোনের বিলের ওপর ২ শতাংশ ও টিআইএন না থাকলে ব্যাংক আমানতের সুদের ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে করের প্রস্তাব করা হয়, যা সব মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। জীবনযাত্রার ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকাই থেকে গিয়েছিল। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার করা হয়েছে। গতকাল সংশোধনীতে করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ন্যূনতম কর কমানোর দাবি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী কোনো কথা বলেননি। মহিলা ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্ববয়সীদের করমুক্ত আয়সীমা বিদ্যমান দুই লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের করমুক্ত আয়সীমা বিদ্যমান দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রপ্তানি খাতে উৎসে কর বাড়ানোর প্রস্তাবে পোশাক খাতসহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন আপত্তি করেছিল। বৈশ্বিক মন্দাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী গতকাল সংসদে ব্যবসায়ীদের এ দাবি বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রীকে। তাতে সাড়া দিয়ে অর্থমন্ত্রী রপ্তানি খাতে উৎসে কর কমিয়ে ০.৮০ শতাংশে নির্ধারণ করেছেন।
ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকার বেশি থাকলে তা থেকে প্রাপ্ত সুদ আয়করের আওতায় আসবে। সে ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হবে কর শনাক্তকারী নম্বর বা টিআইএন।
গতকাল সন্ধ্যায় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর সংশোধনী-সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য উত্থাপন করেন। এগুলো হচ্ছে : মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর উৎসে কর প্রত্যাহার, ব্যক্তি করদাতাদের আয়করমুক্ত সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের আয়করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি, অ্যালুমিনিয়ামের ওপর কর অব্যাহতি, সফটওয়্যার ও ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটরের ওপর কর প্রত্যাহার এবং রপ্তানির ওপর আরোপিত উৎসে কর কমিয়ে আনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বাজটের ওপর ২১১ জন সংসদ সদস্য ৪৯ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট কথা বলেছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠন তাদের মতামত ও দাবি জানিয়েছে। এসব আলোচনা ও মতামতের আলোকেই তিনি অর্থমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব দিচ্ছেন বলে সংসদকে জানান প্রধানমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধানমন্ত্রীর সব প্রস্তাব মেনে নিয়ে তা অর্থ বিলে অন্তর্ভুক্ত করেন। অর্থ বিল পাস করার সময় কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় নির্ধারিত করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন খাত নির্ধারণ করা হবে, কোন খাতে এই অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে। শেয়ারবাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেয়ারবাজার ফলপ্রসূ হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধক্রমে (আদেশ) বিকাশমান শিল্প হিসেবে সফটওয়্যারকে করমুক্ত সুবিধার আওতায় রাখা হয়েছে। অ্যালুমিনিয়াম শিল্পের ওপর আরোপিত কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। সব শ্রেণীর ব্যবহারকারীদের সামর্থ্যের কথা ভেবে ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটর করমুক্ত রাখা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত যাদের ব্যবসা রয়েছে, তাদের করমুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে ৪০ লাখ পর্যন্ত টার্নওভার আগের মতোই সম্পূর্ণ করমুক্ত থাকবে। অ্যালুমিনিয়াম শিটের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বার্ষিক ৭০ লাখ পর্যন্ত টার্নওভারবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো প্যাকেজের আওতায় থাকবে। বিদ্যমান বাজেটে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মূসক অব্যাহতি ছিল। কিন্তু গতকাল প্রধানমন্ত্রী এটি বাড়িয়ে ৭০ লাখ পর্যন্ত টার্নওভার করার প্রস্তাব দেন। অর্থ বিলে তা অনুমোদনও হয়। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার বছরে ৭০ লাখ টাকা, তারা আগের মতোই প্যাকেজের আওতায় কর দেবে। তবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তারা প্যাকেজের আওতায় যে কর দেয় তা কিছু বাড়বে। দোকান মালিকরা এতে রাজি হয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আগামী অর্থবছরে প্রাক্কলিত ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করি। তবে এ জন্য বাস্তবায়ন সক্ষমতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি।'

No comments

Powered by Blogger.