নিরাপদ সড়ক-সাইফ তোমাকে ভুলিনি আমরা by তারানা হালিম

অসম্ভব সুন্দর চেহারা। চোখ দুটো নিরন্তর কথা বলে। কথার শুরুতে হাসি, শেষেও হাসি। বড় মিষ্টি হাসি—মনটা জুড়িয়ে যায়। এখন তো আর ‘যায়’ লিখতে পারি না। ব্যাকরণে ভুল হয়ে যাবে। ‘যেত’ লেখা উচিত। কিন্তু মন কি ব্যাকরণ মানে? যার স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যায় না, তার কথা তো বর্তমান কালেই লিখতে হবে।


সাইফ, আমাকে ডাকে ‘ছোট মা’। খালা তো মা-ই। ওর ডাক এখনো শুনতে পাই আমি।
আমি তো আজকাল টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে সংবাদ, অনুষ্ঠান শুনি কেবল; কোনো চেহারা দেখি না—বিভিন্ন দোকানে মূর্তির গায়ের টি-শার্ট দেখি কিন্তু মূর্তিগুলো দেখি না। সবখানে শুধু একজনেরই চেহারা দেখি, সাইফের; আমার বড় বোনের ছোট ছেলে। ডাকনাম অর্ণব। গত বছরের ২৬ নভেম্বর ভোররাতে কোরবানির গরু কিনে ফেরার পথে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় প্রাণ হারায় ও।
সাইফ চলে যাওয়ার পর থেকে আমরা চলছি, ফিরছি; কিন্তু ভালো নেই। আমরা হাসি না, আনন্দের মাঝে আনন্দ পাই না। একটু ভালো লাগা আর আনন্দের জন্য হাতড়ে বেড়াই। একটু আনন্দে তৎক্ষণাৎ অদ্ভুত এক অপরাধ বোধ জাগে। সাইফ নেই, আনন্দ থাকে কীভাবে! তাই এখন আনন্দ খোঁজাও ছেড়ে দিয়েছি।
মা-বাবাকে হারানোর কষ্ট একসময় নিজেদের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছি। মা-বাবার পর তো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আমার বড় বোন, বড় ভাই বা আমার যাওয়ার কথা। কিন্তু এক প্রজন্ম টপকে পরের প্রজন্মের একজনের—অপরিপূর্ণ এক জীবনের চলে যাওয়া—কীভাবে মানব আমরা!
দুর্ঘটনার আগে সাইফ কাভার্ড ভ্যানটিকে থামানোর জন্য সিগন্যাল দিলেও থামেনি। চালক যদি একটু ব্রেক কষত, তার একটি ব্রেক আমাদের জীবনের সব আনন্দ ধরে রাখত, তার একটি ব্রেক আমাদের অসহনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখি করত না, আমার বোনের জীবনে বেঁচে থাকাকে অভিশাপ করে তুলত না, একটি অপার সম্ভাবনাময় জীবন নষ্ট হতো না।
গত কোরবানির ঈদের দুই দিন আগে সাইফকে হারিয়েছি আমরা। এবারের ঈদে মনকে ভোলানোর জন্য অনেক কিছু কিনেছি, এমনি। ছুঁয়েও দেখা হয়নি। বোনটাকে সবাই মিলে যেন সবকিছু থেকে পালানোর জন্য জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। সাইফের ঘর ছেড়ে ওর মা যেতে চায় না। যদি ছেলে এসে ওকে না পেয়ে ফিরে যায়? ওকে বিদেশে পাঠানোর সময় ওর সঙ্গে সাইফের টি-শার্ট, প্যান্ট সুটকেসে দিয়ে দিয়েছি। কথা দিয়েছি, সাইফের ঘরে বাতি জ্বলবে। গতকাল ওর মা ফিরেছে। প্রথমেই বলল, প্লেনটা ল্যান্ড করতেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।’ হঠাৎ বলল, জীবনটা বড় অদ্ভুত।
লোকে বলে, সময়ে স্মৃতি ম্লান হয়ে যায়। কই সাইফ তো প্রতিদিন মনের মাঝে, মস্তিষ্কের যেখান থেকে স্মৃতি উৎসারিত হয়, সেখানে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে।
আমি যখন সাংসদ হলাম, ওর বাবা পিএসসির সদস্য হয়েছিলেন। তখন ও কিছুই চাইল না। শুধু বলল, ‘ছোট মা, তোমার ভিজিটিং কার্ডটা দাও। হেসে বলেছিলাম, বন্ধুদের দেখাবি? বোকা! আজ সাংসদ, কাল নেই। অস্থায়ী। দেখিয়ে কী হবে?’ বলল, ‘দাও না, মানিব্যাগে রাখব।’ এখনো ওর মানিব্যাগে দুলাভাই আর আমার ভিজিটিং কার্ড রয়ে গেছে।
সাইফ চলে যাওয়ার পর আমার বড় ছেলেটা প্রচণ্ড শুকিয়ে গেছে। ছোট ছেলেটা গভীর রাতে জেগে দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিতে বলে। আমার বোনের বড় ছেলেটা গোপনে বারবার জানতে চায়, ‘ছোট মা, সত্যি করে বলো, আম্মা ঠিক আছে তো?’
না। আমার বোনটা ঠিক নেই। ও বাঁচতে চায় না। রাস্তায় ট্রাক, বাস, ভ্যান দেখলে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ভারী যানের হর্নে ওর হূৎস্পন্দন বেড়ে যায়। ওর সারাক্ষণ মনে হয়, পৃথিবীর কোনো শিশুই নিরাপদে নেই। ওর বাসায় ফোন দিলে ও ভয় পায়—এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ এল। ফোন না দিলেও ভয় পায়—বুঝি কিছু ঘটেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো তরুণের প্রাণহানি ঘটলে সেখানে সে যাবেই। সেই মায়ের হাত ধরে আপা বলে, ‘আপা, তাকান। আমাকে দেখেন।’
চালক ভাইয়েরা, আপনাদের একটু সতর্কতা আমাদের মতো এমন দুঃসহ জীবন থেকে এখনো অনেককে বাঁচাতে পারে। গতির চেয়ে, অর্থের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আমার বড় বোনটা চোখের জলে ভেজা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ’-এর আহ্বান জানায়। যখন ছেলের ভালোবাসার ছবিটাকে পোস্টার বানিয়ে ‘ঘাতক চালকদের শাস্তি’র দাবি জানায়, সাইফের স্মৃতিকে ধরে রেখে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ‘সাইফ ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলে, তখন কেবলই মনে হয়, আমার বড় শান্ত, বড় ধার্মিক, বড় ভালোমানুষ বড় বোনটির পাশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে দাঁড়ানোর নৈতিক দায় এড়িয়ে যাওয়ার অপরাধ, ঘাতক চালকের অপরাধের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়।
২৬ নভেম্বর সাইফ আহমেদ অর্ণবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের উচ্চারণ, ‘আমরা সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিরোধ চাই’।
তারানা হালিম: সাংসদ, সাইফ আহমেদের খালা।

No comments

Powered by Blogger.