নারী, গণমাধ্যম ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা by সেলিনা হোসেন

গণমাধ্যমের দুটি শাখা_ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট। নারীকে বিষয় হিসেবে নির্বাচন করে নানা ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে এই দুটি মাধ্যম। তবে 'নারী ও গণমাধ্যম'কে যখন বিষয় হিসেবে কেউ চিহ্নিত করে, তখন ধরে নেওয়া সংগত যে, এই দুটি শব্দের ভেতর এক অলিখিত এবং অনির্দেশিত বিবেচনা আছে, যা খতিয়ে দেখা জরুরি।


দেখতে হবে, সেখানে ইতি ও নেতি নিজেদের জন্য কতটা জায়গা করে নিয়েছে। এই সূত্র ধরে বলতে হবে, স্বাধীনতার ৪০ বছর ধরে সাধারণ মানুষের মনে নারীসংক্রান্ত ধারণা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে সিংহভাগ ভূমিকা পালন করেছে মুদ্রণমাধ্যম। অথচ দেশের ৬০ শতাংশ নিরক্ষর লোকের জন্য ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অর্থাৎ রেডিও-টেলিভিশনের ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকর। কিন্তু দেখা গেছে, এই মাধ্যম দুটি ব্যাপক অর্থে তেমন বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
কেন পারেনি? আমার বিবেচনায় এর অন্যতম প্রধান কারণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। এই সংস্থা দুটিকে রাষ্ট্র কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বলে যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের মর্জিমাফিক পরিচালিত হয়। ফলে এর নিজস্ব কোনো চরিত্র গড়ে ওঠার সুযোগ হয় না। সংগত কারণেই কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর কার্যকর অনুষ্ঠানমালা তৈরি করে তা জনসাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে হয়। ফলে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও নিছক বিনোদন পরিবেশন করা হয়ে ওঠে তার মুখ্য ভূমিকা, যা সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের গুণগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কাজে আসে না। এই সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা একটি জাতির মননের অগ্রগতিকে পিছিয়ে রাখে। ফলে নারীবিষয়ক ধারণায় যে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হলে একটি সুস্থ প্রক্রিয়ার মধ্যে জীবনযাপন বিন্যস্ত হতে পারে, সেই বোধ থেকে সাধারণ মানুষ দূরে সরে যায়। নষ্ট হয় সামাজিক সুস্থতা ও পারিবারিক হৃদ্যতা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যাই এখানে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে মানুষকে অনেক বেশি সচেতন করতে পারে, এ বোধটি তারা লালন করে না। এই মিডিয়া বিনোদন পরিবেশনের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের প্রচারের মুখপত্র হয়। রাষ্ট্রপ্রধান স্বৈরাচারী হলে তো কথাই নেই, সেটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের গণমানুষের ইলেকট্রনিক মিডিয়াসংক্রান্ত স্বপ্নের অনেকটা এভাবেই চোরাবালিতে পথ হারায়। রক্ষা প্রিন্ট মিডিয়াকে দিয়ে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও রাজাকারদের দ্বারা ধর্ষণের কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের 'বীরাঙ্গনা' উপাধিতে ভূষিত করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। সে এক কঠিন সময় ছিল আমাদের জীবনে। অসংখ্য ধর্ষিত নারীর পুনর্বাসন এবং যুদ্ধশিশুর সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছিল সেই সময়কার সরকারকে। ১৯৭২ সালে এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল 'নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন'। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে বীরাঙ্গনা শব্দটি থিতিয়ে গেছে। সামনে এগিয়ে এসেছে অন্য শব্দ। এখন উচ্চারিত হচ্ছে 'মহিলা মুক্তিযোদ্ধা'। নারীসংক্রান্ত সাংস্কৃতিক বিবেচনার এই একটি বোধ, এমন একটি গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে আমাদের ৪০ বছর সময় লেগেছে। যাঁরা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, এই শব্দের ভেতর যে গৌরব আছে, সেই গৌরব বোধ নারীকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে। তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এর চেয়ে বেশি কিছু হয়তো ভাবা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা এ ব্যাপারে হয়েছে উল্টো। দেশের অপরিশীলিত রুচিহীন সাংস্কৃতিক বোধ নারীকে এই সম্মান দিতে তৈরি ছিল না।
যুদ্ধ কিংবা সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রাকৃতিক নিয়মে নারীকে খানিকটা বাড়তি মূল্য দিতে হয়। এই মূল্য যুদ্ধের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে না কেন? যুদ্ধকালে যে কারণে একজন যুবককে হত্যা করা হয়, সেই একই কারণে একজন নারী ধর্ষিত হন। এই বোধটি বুঝে উঠতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। আর এই রূপান্তরের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে প্রিন্ট মিডিয়া। ৩৯ বছর ধরে অসংখ্য লেখালেখি এই মৌল সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। আমাদের সংস্কৃতিতে নারীসংক্রান্ত বিবেচনার এটি একটি প্রচণ্ড অভিঘাত। একটি জনযুদ্ধ নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব হতে পারে না_এটা যেমন মৌলিক সত্য, তেমনি তারামন বিবি বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত হয়ে এ ধারণাকে স্থায়িত্ব দিয়েছেন। তেমনি ডা. সেতারা বেগম বীরপ্রতীকও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে নারীর যুদ্ধে অংশগ্রহণের ভিন্ন প্রেক্ষিত মূর্ত করেছেন। উপাধিতে ভূষিত না হলেও আরো অসংখ্য নারী আছেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তারামন বিবিকে জনগণের সামনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব প্রিন্ট মিডিয়ার। নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন। এটি একটি বড় ঘটনা।
অধিকার মানুষের বেঁচে থাকার নূ্যনতম চাহিদার স্বীকৃতি। যদি তা-ই হয়, তাহলে শুধু নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কেন? যেখানে বঞ্চনা, সেখানেই অধিকারের প্রশ্ন। আর নারীর বঞ্চনার শেকড়টি অনেক গভীরে প্রোথিত। কেননা, এই সংস্কৃতির একটি লক্ষণীয় দিক হলো, নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে তাকে মেয়ে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা। ফলে মৌল সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে এই সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি বিবেচনা অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। তবে এটাও ঠিক, ৬০ শতাংশ নিরক্ষরের দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়াই নারীসংক্রান্ত ধারণা রূপান্তরের ক্ষেত্রে দ্রুত কার্যকর মাধ্যম। 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি'র ১৩ অনুচ্ছেদে 'নারী ও গণমাধ্যম' শিরোনামে বলা হয়েছে, 'গণমাধ্যমে নারীর সঠিক ভূমিকা প্রচার, প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং অংশগ্রহণে বৈষম্য দূর করা; গণমাধ্যমে নারী ও মেয়েশিশুর অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি; নারী ও মেয়েশিশুর প্রতিফলন ঘটানো এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর, নেতিবাচক, সনাতনী প্রতিফলন ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা...ইত্যাদি।' যদি এভাবে এগোনো যায়, তাহলে নারীসম্পর্কিত ধারণায় জনসাধারণ দ্রুত নিজেদের শিক্ষিত করে তুলতে পারবে।
তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের টেলিভিশনে নারীসংক্রান্ত প্রচারের ধারণা নেতিবাচক। জাতীয় সংবাদের একটি দৃশ্যের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনো এক (জায়গার নাম ভুলে গেছি) বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। জনসভার হাজার হাজার মানুষের মুখের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ। বোঝা যায়, ক্যামেরার কৌশল। প্রধানমন্ত্রীকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের চেষ্টা। আমার মতে, এটি সুস্থ চিন্তার চেষ্টা নয়। যে দরিদ্র-নিরন্ন মানুষ ওই জনসভায় উপস্থিত হয়েছিল, তারা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সুন্দর চেহারা দেখতে যায়নি। তারা গিয়েছিল, তিনি সেই এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য কী করবেন, তা জানতে। আর টেলিভিশনের সামনে বসে ভাবছিলাম, প্রধানমন্ত্রী তখনই সুন্দর হয়ে উঠবেন, যখন তিনি জনসাধারণের কল্যাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবেন। গণমাধ্যমকে সংস্কৃতির এই তাৎপর্যময় বোধগুলো অনুধাবন করতে হবে। নইলে নারী নারীই থাকবেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁকে আলাদা মর্যাদা দেবে না।
এমনিভাবে টেলিভিশনের খবরের আরো একটি বিষয় খুবই অমর্যাদাকর মনে হয়_কোনো আলোচনা কিংবা সেমিনারে দর্শকদের সারি থেকে অযৌক্তিকভাবে একটি সুন্দর মেয়ে কিংবা একজন মহিলাকে ক্লোজআপে দেখানো। ভাবটা এমন, সেমিনারের জ্ঞানী-গুণীদের চেয়ে এই মুখটি দেখালে দর্শকরা বেশি খুশি হবে। ক্যামেরাম্যানরা সবাইকে চিনবেন_এমন ধারণা করা সংগত নয়। কিন্তু তাঁরা জ্ঞানী-গুণীজনের নাম তো সভার আয়োজকদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। আসলে অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারেন না, কাকে কতটুকু দেখালে টেলিভিশনের সংবাদের গুরুত্ব বাড়বে। এটা সংস্কৃতির ব্যর্থতা।
তবে এটাও সত্য, নারীদেরও দায়িত্ব আছে নিজেদের জন্য। অনেক সময় দেখা যায়, টেলিভিশনের নাটকে নায়িকা একটি চরিত্র রূপায়ণ করতে গিয়ে কী ধরনের পোশাক পরবেন, সেটাও নির্ধারণ করতে পারেন না। নিজেকে অকারণে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য চরিত্রটির কথা ভুলে যান। পোশাকের বাড়াবাড়িতে সেটা ফ্যাশন শোর মতো হয়ে যায়। নাটকের যে চরিত্রটি তিনি রূপায়ণ করছেন, তার প্রতি সুবিচার করেন না। এটা কারোই ভোলা উচিত নয়, নাটক একটি শিল্পমাধ্যম। এর যথাযথ রূপায়ণই দর্শকের কাছে কাম্য। গণমাধ্যমকে নিজেদের অনুকূলে গড়ে তোলার জন্য নারীকেও ব্যাপক দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনায়াসে পুরুষের হাতের ক্রীড়নক হয়ে যাওয়া আর কত কাল? কারণ, পুরুষ নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে গণমাধ্যমে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। নারীরও উচিত কতটুকু ব্যবহৃত হবেন, সেই সীমানা নির্ধারণ করা। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নয়নশীল প্রায় প্রতিটি দেশেই কমবেশি বিদ্যমান। এমনকি উন্নত দেশের টেলিভিশনেও যে এমন দৃশ্য দেখা যায় না, তা নয়। নারীকে পণ্য হিসেবে ভাবার জায়গাটি বদলানো যে কতটা জরুরি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা এখন তো কঠিন নয়। কারণ, সময় যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে
অনেক কিছু।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.