আধেক ঘুমে অর্ণব by মেহেদী মাসুদ

বাইরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ় মাস। সোমবার। ঘড়িতে তখন দুপুর দেড়টা। গুলশানে অর্ণবের বাসায় আড্ডা হবে। এ সপ্তাহে বেরিয়েছে তাঁর নতুন অ্যালবাম, আধেক ঘুমে। সময়টা আগেই নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু হায়! অর্ণব তখনো ঘুমোচ্ছেন।


ভাতঘুম? না, ভেতর থেকে একজন মহিলা এসে জানালেন, অর্ণব সারা রাত স্টুডিওতে কাজ করেছেন।
আধেক ঘুমে প্রকাশ করেছে আধখানা মিউজিক। পরিবেশনার দায়িত্বে বেঙ্গল মিউজিক। আর এফএম রেডিওতে গানগুলো শোনা যাচ্ছে শুধু এবিসি রেডিওতে।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষার পর পাওয়া গেল অর্ণবকে। বসার ঘরে ঢুকেই দেরি হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। নিয়ে গেলেন নিজের রুমে। আড্ডার শুরুতেই অ্যালবাম প্রসঙ্গ। অ্যালবামের নাম আধেক ঘুমে কেন? অর্ণব বললেন, ‘আমি গান শিখেছি শান্তিনিকেতনে। নয় বছর বয়সে সেখানে গিয়েছি। এরপর টানা ১৭ বছর ছিলাম। ওখানে পাঠভবনে সরাসরি ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস টুতে। গান শেখা ছিল পড়াশোনার একটা অঙ্গ। অবশ্যই রবীন্দ্রসংগীত। ক্লাস টুতে প্রথম শিখেছি “আধেক ঘুমে” গানটি। এবারই প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম করছি। অ্যালবামে ওই গানটি তো থাকছেই, আর নামও রেখেছি আধেক ঘুমে। আমি কিন্তু ওখানে স্নাতকোত্তর করেছি চারুকলায়।’
আধেক ঘুমে অ্যালবামের গানগুলো নিয়ে বললেন, ‘শান্তিনিকেতনে অসংখ্য গান শিখেছি। এই গানগুলো তার মধ্য থেকেই নেওয়া। তবে “রবির গান” গানটি আমার তৈরি।’
শান্তিনিকেতনে স্কুলের সেই দিনগুলো কেমন ছিল? অর্ণবের চেহারায় অন্য রকম একটা আনন্দের ঢেউ লেগেছে। বললেন, ‘আমার মা ছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী। তিনিই আমাকে সেখানে পাঠভবনে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ওখানে গিয়ে স্কুলের ধারণাটাই পাল্টে যায়। ক্লাসরুম কোথায়! এখানে তো বিভিন্ন গাছের তলায় দলে দলে ছেলেমেয়েরা বসে পড়ছে। ছেলেদের পরনে সাদা শার্ট আর কমলা রঙের হাফপ্যান্ট। সবার পায়ে স্যান্ডেল। বই নেওয়ার বাক্সটাও অদ্ভুত। পরিবেশটা দারুণ লেগেছিল। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। খোলা মাঠ। আমি যেন এক নতুন জগতে এসেছি।’
অর্ণব ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে নাচ শিখেছেন। নাচের ক্লাস ছিল বিকেলবেলায়। আর ওদিকে বন্ধুরা সবাই ফুটবল খেলছে। নাচ নয়, মন পড়ে থাকত সেখানে। বন্ধুরাও নাচ নিয়ে তাঁকে খুব খেপাত। শেষে একদিন ইচ্ছে করেই নাচের ক্লাসে গেলেন দেরি করে। দিদিমণি বকুনি দিলেন। এরপর আর নাচের ক্লাসে যাননি। কথা বলতে বলতে বের করে দেখালেন শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর নাচের ছবি। সেখানে আরও শিখেছেন কারাতে। ছিলেন ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন।
অর্ণব তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের ভোটে সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাংস্কৃতিক, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিভাগের সম্পাদকদের কাজ দেখাশোনা করতেন তিনি।
অর্ণবের গান মানে চাই না ভাবিস (২০০৫), হোক কলরব (২০০৬), ডুব (২০০৮), রোদ বলছে হবে (২০১০) অ্যালবামগুলো। হঠাৎ রবীন্দ্রসংগীত কেন? ‘নতুন গান নিয়ে আর ভাবতে পারছিলাম না। কী করব, ভেবেও পাচ্ছিলাম না। শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেই আশ্রয় নিলাম।’ বললেন অর্ণব।
বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে পিয়ানো, গিটার আর কিবোর্ডে বেশ দক্ষ অর্ণব। জানালেন, শান্তিনিকেতনে প্রায় প্রতিদিন ভোরে ক্লাস শুরুর আগে তিনি যেতেন উত্তরায়ণে। সেখানে পিয়ানো বাজাতেন। ওই পিয়ানোটি ছিল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কলকাতার জোড়াসাঁকো থেকে আনা হয়েছিল পিয়ানোটি। যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য অর্ণবের ওপর দায়িত্ব ছিল পিয়ানোটি নিয়মিত বাজাতে হবে।
আধেক ঘুমে অ্যালবামের গানগুলোর সঙ্গে পিয়ানোর ব্যবহার গুরুত্বের সঙ্গে করেছেন অর্ণব। অর্ণব নয়, এখানে পিয়ানো বাজিয়েছেন তাঁর বন্ধু আইভিন্ড লোডেমেল।
আলাপের মধ্যে আলোকচিত্রী খালেদ সরকারের অনুরোধ, ‘বৃষ্টি থেমেছে, ছবি তুলতে হবে।’ স্থান ওই অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ। অর্ণবের হাতে হাওয়াইন বাদ্যযন্ত্র ইউকেলেলি।
ছাদের কার্ণিশে উঠে বসলেন অর্ণব। ছবি তোলার ফাঁকে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। একসময় বন্ধুদের সঙ্গে আমার একটা পছন্দের খেলা ছিল নানা উপায়ে বেয়ে বেয়ে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে ওঠা। আর তা করতে গিয়ে আমার দুটো দাঁত ভেঙেছিল।’
বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। এবার থামতে হলো। অর্ণব তাঁর অ্যালবামের একটি কপি হাতে দিয়ে বললেন, ‘গানগুলো শুনবেন। আশা করি ভালো লাগবে।’

No comments

Powered by Blogger.