রূপকল্প যেন রূপকথা হয়ে না যায় by শামসুল আরেফিন খান

মহাজোট সরকার চলতি মেয়াদের শেষ বেলায় এসে পড়েছে তোপের মুখে। জনমতের রোষানলও যেন আসছে ধেয়ে। রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ জমেছে। অর্থনীতির ওপর বৈশ্বিক সংকটের কালো ছায়া পড়েছে। দলীয় সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত বলছেন, বিদ্যুৎ-যানজট সমস্যা কাটানো না গেলে নিশ্চিত ভরাডুবি ঠেকানো যাবে না।


এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে কোনো কোনো মন্ত্রী অসময়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে এবং বক্তব্যে-বচনে বেতাল ও বেসামাল হয়ে নাকাল হচ্ছেন। তবে জীবনসংসারে ভালো-মন্দ আছে পাশাপাশি। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ আসে-যায় আগে পরে। মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় গ্লাস অর্ধেকই খালি, কথাটা হতাশার বাণী। তার মানে, সবটাই শূন্য নয়। যার অর্ধেক পূর্ণ, তার বাকি অর্ধেকও পূর্ণ হতে পারে। শেষেরটা ইতিবাচক, সম্ভাবনা ও আশাবাদের পুরনো কথা। তবে বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিসিন স্কুলের শিক্ষক আরভিং কারসচের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণার সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য বিষয়টিতে নতুন মাত্রা দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার দুই মনোবিজ্ঞানী ম্যারিয়ান গ্যারি ও রবার্ট মিখায়েল গবেষণাটি করেছেন। তাঁদের মতে, কোনো কিছুর ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তা করলে সেটা বাস্তবে রূপ পায়। আশাবাদ মানুষের মনে প্রত্যাশার বীজ বপন করে এবং তাকে আত্মসম্মোহিত করে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। সেই আলোকে মহাজোটের নন্দিত প্রধানমন্ত্রী ও বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে আশাবাদ সঞ্জীবিত ও আত্মসম্মোহিত হয়ে কর্মযজ্ঞে নিবেদিত দেখতে পাই। তারই ফলে নানাবিধ হতাশার মধ্যেও অরুণালোকে উদ্ভাসিত হয়েছে বদ্বীপ বাংলার সবুজ-শ্যামল বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি। চিরবঞ্চিত দলিত কৃষকের মনের বিষণ্ন অনালোকিত কোণে এবং তার শতছিন্ন শয্যার ওপর আশা জাগানিয়া জ্যোৎস্নার সোনালি আলো আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। হতদরিদ্রের জন্য খাদ্যনিরাপত্তামূল বিস্তৃত হয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্কের অনেক গুমোট কেটে গেছে। সমুদ্রজয়কে নতুন প্রজন্ম মহান একাত্তরের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিজয় হিসেবে দেখছে।
আমাদের স্মরণে আছে, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে নিজেরাও পরবর্তী আমলে মোটা মাশুল গুনেছে। একইভাবে এখন দেখছি, জন্মলগ্নে জংলী আইন বলে কঠোরভাবে নিন্দিত বিএনপির দ্রুত বিচার আইনের অক্টোপাস বাহুতে আটকে পড়েছেন এ সময়ের বিরোধী জোটের কয়েক বিশিষ্ট নেতা-কর্মী। আর সেই কুখ্যাত আইনের বিখ্যাত জনক, স্বনামধন্য আইনজীবী সর্বঘটেষু রাজনীতিক সখাদসলিলে নিমজ্জমান সহকর্মীদের উদ্ধারে নেমে আদালতের দরজায় দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে স্যুটেবুটে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছেন। আমার বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে প্রতিহিংসার কৃষ্টি-সংস্কৃতি সমাধিস্থ করার লক্ষ্যে আলোচিত বর্বর আইনের বিষদাঁতগুলো উপড়ে ফেলা উচিত।
এটা বাজেটের মৌসুম। মহাজোট সরকারের চলতি মেয়াদের চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ বাস্তবায়নযোগ্য শেষ বাজেট হাস্যোজ্জ্বল মুখে উপস্থাপন করেছেন বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত। তীক্ষ্ন মেধার দক্ষ আমলার বিভাময় ভাবমূর্তি নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে এরশাদ সরকারের টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন অবসরজীবনের প্রারম্ভে। কিন্তু মহাজোট সরকারে তিনি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী। দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। 'মহাজোটের মন্ত্রী' হিসেবে তিনি কতটা সফল এবং কতখানি ব্যর্থ, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বহুল আলোচিত দিন বদলের সনদের কথা মনে পড়ে। 'আমরা ২০২০-২১ সাল নাগাদ এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে সম্ভাব্য উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম একটি দ্রুত বিকাশশীল অর্থনীতি দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে।... গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র।'
আমরা দেখতে পাই, পুঁজিবাদকে মানবিক রূপ দিয়ে সমাজতন্ত্রের ইতিবাচক অবদানগুলো পুঁজিবাদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে পাশ্চাত্যজুড়ে পুঁজিবাদী বিশ্বে কল্যাণরাষ্ট্র গড়ার প্রক্রিয়া চলছে। তার সঙ্গে জাতির জনকের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি দেখার স্বপ্নের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী বিগত সাড়ে তিন বছরে কতটুকু অবদান রেখেছেন, তার ওপরই 'মহাজোটের অর্থমন্ত্রী' হিসেবে তাঁর সাফল্য ও ব্যর্থতা যাচাই হতে পারে। কিন্তু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ বলে দেয়, তাঁর সাম্প্রতিক বাজেট বক্তৃতায় ঐন্দ্রজালিক বাগ্মিতার ফেনিল উচ্ছ্বাসের মধ্যে হারিয়ে গেছে জাতির জনকের স্বপ্নপূরণে তাঁর নিজের, দলের এবং ক্ষমতাসীন সরকারের দায়বদ্ধতার কথা।
আমাদের শেয়ারবাজারে চলমান আশ্চর্য ভেলকিবাজির যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছেন ঢাকার তরুণ বিনিয়োগকারী কাজী লিয়াকত আলী এবং চট্টগ্রামের দিলদার আহমদ। অর্থসম্পদ খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে হাজার হাজার স্বল্পবিত্তের ভাগ্যান্বেষী মানুষ। কিন্তু সর্বজনবিদিত যে 'ত্রি-দানব' এবং তাদের সহায়ক কতিপয় রাঘববোয়াল ছোট ছোট বিনিয়োগকারীকে উদরস্থ করছে, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে নতশির কেন অর্থমন্ত্রী, তার কোনো জবাব মেলে না। আমাদের পুঁজিবাজার যতই ক্ষুদ্র হোক, সামাজিক অর্থনীতির ওপর তার প্রভাবকে তুচ্ছ ভাবা যায় না। স্মর্তব্য যে শেয়ারবাজারের ধস থেকেই ইউরোপ-আমেরিকায় সূত্রপাত হয়েছিল ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৬ পর্যন্ত সুদীর্ঘ বিশ্বমন্দার। ১৯৭৩ সালে প্রথমে ভিয়েনা ও পরে নিউ ইয়র্ক স্টক মার্কেট বন্ধ হয়ে গেলে থমকে যায় শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ। বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বৃহৎ এক মন্দা অনুভূত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, ১৯২৯ সালে, যা প্রলম্বিত হয়েছিল প্রায় চলি্লশের দশক পর্যন্ত। তারও সূত্রপাত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের ধস থেকে।
সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দার অভিঘাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারাটা আমাদের পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। অবশ্য তার পুরো কৃতিত্বই প্রাপ্য কোটি ছুঁই ছুঁই প্রবাসী বাঙালির তাদের দেশপ্রেম ও প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এই দুর্দিনে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। পোশাক শিল্প ও কমবেশি অবদান রেখেছে। এতদসত্ত্বেও 'দুষ্টু' শেয়ারবাজারে পৌনঃপুনিক ধস নামার ব্যাপারটা খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। উটপাখির মতো আচরণ বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে এবং তার দায়দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর ঘাড়েই উঠবে। তাই সময় থাকতেই সতর্ক হওয়ার জোর তাগিদ অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা সন্তোষজনক হারে কমে এসেছে। এটা আমাদের দুর্বল অর্থনীতির একটা ইতিবাচক দিক। বৈদেশিক ঋণে ঘি খেয়ে দেশের পরগাছা মধ্যস্বত্বভোগী ভাগ্যবানদের মেদভুঁড়ি স্ফীত হয়েছে উদ্বেগজনক হারে। টাকার গরমে টাক চকচকে হয়েছে। ভাগ্যবান ভোগবাদীরা এখন আকাশচুম্বী অট্টালিকার ছাদে হেলিপ্যাড বানিয়ে দুঃসহ যানজটের দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ লাভের স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু দেশের ৯৯ ভাগ অভাগা মানুষের অন্নকাড়া টাকায় বিদেশি ঋণের ১৫ আনা শোধ করেও যেন সাড়ে ১৫ আনাই অপরিশোধিত থাকছে সনাতন চক্রবৃদ্ধির নিয়মে। যে শিশু জন্ম নিয়েছে কাল রাতে তার মাথায়ও রয়েছে সেই ঋণের বোঝা। প্রজন্মকে এই দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি দিতে হবে। এই দায়িত্ববোধ মাথায় রেখে আন্তরিকভাবে কাজ করলে ঋণনির্ভরশীলতা সম্পূর্ণ ত্যাগ করা সম্ভব। পর্যবেক্ষক এবং বিষয়সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শেয়ার মার্কেটটা রাক্ষস-হাঙ্গরদের গ্রাস থেকে মুক্ত করে পুনরুজ্জীবিত পুঁজিবাজার থেকেই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় আর্থিক আনুকূল্য নেওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। বিত্তবানদের জগৎ-অজ্ঞাত পন্থায় কর ফাঁকি রোধ, ভূমি নিবন্ধনে সর্বজনের চেনা মূল্য কারচুপি কঠোর হাতে দমন, মূসক আদায়ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা সৃষ্টি এবং শুল্ক ব্যবস্থাপনার গলদ দূর করে নিঃসন্দেহে বিপুল রাজস্ব পাওয়া যাবে।
এ বছরও নতুন বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান হিসেবে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা- ৯.৭ শতাংশ আর্থিক সহায়তা নেওয়ার ভাবনা রয়েছে। যদিও বিদায়ী অর্থবছরে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প) পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমাতে হয়েছিল কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক সাহায্য না পাওয়ায়। বৈদেশিক উৎস থেকে আশা করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। সংশোধন করে কমানো হয়েছে তার প্রায় অর্ধেক। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের টালবাহানা জাতির অনেক বড় একটা স্বপ্ন ও আশার ওপর ছাই ফেলেছে।
অর্থমন্ত্রীর সব ভাবনার সঙ্গে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় হচ্ছে না। জাতির জনকের স্বপ্ন, ৩০ লাখ শহীদের প্রত্যয় এবং সবহারানো মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তিম প্রত্যাশা পূরণের কোনো নিশ্চয়তাও মিলছে না। কাজেই মহাজোটের প্রাজ্ঞ অর্থমন্ত্রীকে গোল্ডেন জিপিএ ৫ দেওয়া যায় কি না সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। এ ব্যাপারে সুচিন্তিত রায় দেবে দেশের প্রকৃত মালিক জনগণ ২০১৩ সাল শেষ হতেই।
এ সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে দেশবাসীর সবচেয়ে বড় চাওয়া একটাই এবং তা হচ্ছে, মহাজোটের ঘোষিত রূপকল্পের সার্থক রূপায়ণের কার্যকর পদক্ষেপ এবং সে রূপকল্প যাতে রূপকথার সোনার হরিণে রূপান্তরিত না হয়, সোনার পাথর-বাটি সেক্যুলার বাংলাদেশের মতো, তার নিশ্চয়তা।

লেখক : সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
email : muktisakhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.