শ্রদ্ধাঞ্জলি-জগদীশচন্দ্র বসুর কথা বলি by সুরঞ্জিত বৈদ্য

‘বাবা জানো, আজ একটা ঝোপে দেখলাম আগুন জ্বলছে—অনেক আগুন। কাছে গিয়ে দেখি, ঝোপে নয়, এক রকম মাছির গায়ে আগুন জ্বলছে আর নিভছে। ও মাছিগুলো জ্বলে কেন, বাবা?’ জোনাকিপোকা দেখে সেদিন যে শিশুটি বাবার কাছে প্রশ্নটি করেছিল, তিনি আর কেউ নন, বাংলার বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।


বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন সেই আমলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৮৮০ সালে জগদীশচন্দ্র সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় বিএ পাস করে বাবার ইচ্ছায় বিলাত যাত্রা করেন। তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৮১ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। চার বছর পড়াশোনার পর ক্যামব্রিজ থেকে বিজ্ঞানে ‘ট্রাইপস’ (তিনটি বিষয় অনার্স—পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও উদ্ভিদবিদ্যা) লাভ করেন। সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ার সময় জগদীশচন্দ্র প্রকৃতিবিজ্ঞানের প্রথিতযশা অধ্যাপক ফাদার লাফোঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। এই লাফোঁই জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানজীবনের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। সেই ভিত আরও মজবুত হয় ক্যামব্রিজের বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক লর্ড র‌্যালি (পদার্থবিদ্যা) ও অধ্যাপক ভাইনেসর (উদ্ভিদবিদ্যা) সংস্পর্শে এসে। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই তিনি ভারতে ফিরে আসেন।
বিলাতফেরত যুবকের বুকে তখন স্বদেশের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা, মস্তিষ্কে অগাধ জ্ঞান। ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী এবং বাবার বন্ধু দুর্গামোহন দাসের মেয়ে অবলা দাসকে বিয়ে করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি জগদীশচন্দ্র গবেষণার কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এ গবেষণার জন্য তিনি একবিন্দুও সরকারি সাহায্য পাননি। প্রেসিডেন্সি কলেজেও তেমন উন্নত ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছিল না। ছিল না কোনো গবেষণাগার। তবু এর মধ্যে তাঁর গবেষণার কাজ চলতে থাকে। জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকর্ম দুই পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায়ে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল পদার্থবিজ্ঞান। এ পর্যায়ে তিনি প্রথমে গবেষণা করেন ‘অদৃশ্য আলোক’ সম্পর্কে। এরপর তাঁর চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী আবিষ্কার হলো ‘বিনা তারে বার্তা প্রেরণ’। কিন্তু পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের মুনাফার মারপ্যাঁচে নিজেকে জড়াতে চাননি বিধায় এই কৃতিত্ব শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। দ্বিতীয় পর্যায় প্রথম পর্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রথম পর্যায়ের গবেষণাকর্মের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মের সূত্র খুঁজে পান। এ পর্যায়ে গবেষণা করেন জড় ও উদ্ভিদজগৎ নিয়ে। আমাদের চারপাশে যে ভাষাহারা তরুরাজি আমাদের স্নেহ ও ভালোবাসার জগৎ থেকে দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে, বিজ্ঞানী তাঁদেরই অকথিত বাণী উদ্ধারে তাঁর পুরো সাধনাকে নিয়োজিত করেন। তাঁর অন্তরের সব মমতা ঢেলে তিনি এদের জীবনের গূঢ় রহস্যের আবরণ ধীরে ধীরে উন্মোচন করে দেন বিশ্বজনের কাছে। তিনি নিজের আবিষ্কৃত যে যন্ত্রটির সাহায্যে উদ্ভিদের চেতনাশক্তি ধরতে সক্ষম হন, তার নাম ‘রেজোন্যান্ট রেকর্ডার’। এই যন্ত্রের সাহায্যেই বৃক্ষের বিবিধ স্পন্দন লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উদ্ভিদটির বৃদ্ধির পরিমাণও মুহূর্তে নির্ণয় করা যায়। এতে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে কোটি গুণ বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়।
জগদীশচন্দ্র তাঁর আবিষ্কার ও বিজ্ঞান গবেষণার ওপর বক্তৃতাদানের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বহুবার আমন্ত্রিত হয়েছেন। সান্নিধ্য লাভ করেছেন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও খ্যাতনামা পণ্ডিতদের। তাঁদের মধ্যে আছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ, ঔপন্যাসিক রে‌্যামা রোঁলা প্রমুখ। ৩১ বছর অধ্যাপনার পর জগদীশচন্দ্র ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নেন। এর দুই বছর পর ১৯১৭ সলে সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন বৈজ্ঞানিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এই মহান বিজ্ঞানীর গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৮৯৬ সালে তাঁকে ডিএসসি উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯০৩ সালে ভারত সরকার তাঁকে সিআইই উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে জগদীশচন্দ্রকে সিএসআই খেতাবে সম্মানিত করা হয়। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি উপাধি দেয়। ১৯১৭ সালে তাঁকে ‘নাইট’ বা স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯২০ সালে তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৬ সালে তিনি জাতিসংঘের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা সংসদের সভ্য মনোনীত হন। ১৯২৭ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে ভিয়েনার একাডেমি অব সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি দেয়। জগদীশচন্দ্রের গবেষণা ও অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার দেখে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সশ্রদ্ধচিত্তে বলেছিলেন, ‘জগদীশচন্দ্রের প্রতিটি আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে একেকটি বিজয়স্তম্ভ।’ জগদীশচন্দ্রের আজীবন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চারদিকে তাঁর সুখ্যাতি অনুধাবন করে লিখেছিলেন—
‘বিজ্ঞানলক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিমমন্দিরে
দূর সিন্ধুতীরে
হে বন্ধু গিয়েছো তুমি; জয়মাল্যখানি
সেথা হতে আনি
দীনহীনা জননীর লজ্জানত শিরে
পরায়েছ ধীরে।’
জগদীশচন্দ্র শুধু যে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন তা-ই নয়, একান্ত সংগোপনে তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটি সুন্দর কবিমন, একটি লেখকসত্তাও। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিও ছিলেন দুই বছর। তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থ অব্যক্ত বাংলা সাহিত্যেরও একটি বিশিষ্ট সংযোজন।
১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর আজকের এই দিনে জগদীশচন্দ্র ঢাকার অদূরে বিক্রমপুর পরগনার রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর বিহারের গিরিডিতে পরলোকগমন করেন। তাঁর জন্মদিবসে এই মহান বিজ্ঞানীর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।

No comments

Powered by Blogger.