ধর্ম-এইডস প্রতিরোধে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

পৃথিবীতে এইডসের মতো ভয়ংকর প্রাণসংহারী রোগের প্রকোপ যেভাবে বাড়ছে, সেখানে মানুষকে রক্ষা করতে পারে ধর্মীয় অনুশাসন। মরণব্যাধি এইডসের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা গণসচেতনতা বৃদ্ধি, ইসলামের বিধিবিধান ও সামাজিক অনুশাসন মেনে বিশ্বস্ত ও নিরাপদ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ এবং এইচআইভি


ভাইরাসবিহীন রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা যায়। নৈতিকতার আদর্শে জনগণকে অনুপ্রাণিত করে কঠিন রোগব্যাধি সম্পর্কে সচেতন করা সমাজের ধর্মীয় নেতা বা ইমামদের দায়িত্ব। জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ প্রভৃতি আদর্শ জাতি গঠনের লক্ষ্যে মসজিদের ইমামেরা প্রতি শুক্রবার সাপ্তাহিক জুমার খুতবায় অত্যন্ত মূল্যবান উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘লোকেরা যখন কোনো মন্দ কাজ দেখেও তা পরিবর্তনে কোনো চেষ্টা না করে, তখন খুবই আশঙ্কা থাকে যে আল্লাহ তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এর শাস্তির বিধান করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
যেসব কারণে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায়, এর প্রায় সবগুলোকে ইসলাম আজ থেকে প্রায় এক হাজার ৪০০ বছর আগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচার শুধু চরম অশ্লীলতাই নয়, যাবতীয় অন্যায় ও কুকর্মের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। অবাধ যৌন মিলন ও ব্যভিচার পারিবারিক বন্ধনকে বিনষ্ট করে এবং সামাজিক জীবনকে বিষময় করে তোলে; তাই ব্যভিচারের মতো বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার শুধু পরিত্যাগ করাই উচিত নয়, বরং এর সংস্রব ও কামনা-বাসনা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেছেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না, নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩২)
ঘাতক ব্যাধি এইডসসহ অনেক জটিল রোগের জন্য দায়ী ব্যভিচার নামক সামাজিক অনাচার। অবৈধ মিলন ও ব্যভিচারের ফলে জন্ম নেওয়া বা গর্ভে থাকা শিশুর অধিকারের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। ইসলাম ব্যভিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করে পৃথিবীতে সুস্থ-সুন্দর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন যাপনে সমর্থ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইসলাম নর-নারীর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বাইরে কোনো দৈহিক মিলন অনুমোদন করে না। অবাধ যৌনাচার থেকে দূরে থাকাই মরণঘাতী এইডস থেকে মুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। অথচ বাংলাদেশ বর্তমানে এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে এসব বিষয়ে সচেতনতার ঘাটতি দেখা যায়। এখনই এ ব্যাপারে ধর্মভীরু লোকেরা সজাগ-সচেতন হলে জাতি এইডস থেকে বহুলাংশে রক্ষা পাবে।
নিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন তথা বিবাহিত নারী-পুরুষের সহবাসে এইডসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই, যদি না স্বামী-স্ত্রীর কোনো একজন বিপথগামী হয়ে থাকে। ইসলাম কখনো মানুষের যৌন চাহিদাকে অবদমিত করার পরামর্শ দেয় না বলে বিবাহপ্রথা চালু আছে। পক্ষান্তরে বিয়ে না করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; এটি মানুষকে ব্যভিচার, অবাধ যৌন মিলনের কাজে ধাবিত করে। বর্তমান বিশ্বে এইডস মহামারি আকার ধারণ করেছে। অবৈধ যৌনাচার ও ব্যভিচারকে মহামারির কারণ হিসেবে হাদিস শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ্যভাবে চলতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ ও এমন অভিনব দুরারোগ্য ব্যাধি দেওয়া হয়, যা তাদের পূর্বপুরুষেরা কখনো শোনেনি।’ (দায়লামি) নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘যখনই কোনো জাতি বা সম্প্রদায় অশ্লীল ও ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে এমন এক ভয়ংকর মহামারি দেখা দেয়, যা তারা অতীতে কখনো দেখেনি।’ (ইবনে মাজা)
অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচার এইডস বিস্তারে অন্যতম ভূমিকা পালন করে, তাই ইসলাম বিবাহবহির্ভূত অবাধ নিয়ন্ত্রণহীন যৌনকর্ম অনুমোদন করে না। সমকামিতা ও বহুগামিতা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও মানবিক বিচারে একটি ভয়ানক অপরাধ। আধুনিক মানবসভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ সমকামিতার মধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধি এইডসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। যারা অবৈধ যৌনাচার, সমকামিতা, অনৈতিক, অশ্লীল ও ঘৃণ্য কাজে জড়িত; তাদের কঠোর শাস্তির ভয় দেখিয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমি লুতকে প্রেরণ করেছিলাম যখন সে তার জাতিকে বলেছিল: তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বে কেউ করেনি? তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন করো, তোমরা তো সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৮০-৮১)
ধর্মীয় অনুশাসনের যথার্থ অনুশীলন না করার জন্য বর্তমানে এইডসের মতো ভয়াবহ রোগ ছড়িয়েছে। হজরত লুত (আ.)-এর সম্প্রদায় নবীর আদেশ লঙ্ঘন করে বিকৃত যৌনাচার বা সমকামিতার অপরাধে আল্লাহর এমন গজবে পতিত হয়েছিল যে পুরো জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এমনিভাবে আল্লাহর নির্দেশিত সীমা লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি যে কত কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য ইসলামি মূল্যবোধের কারণে ধর্মপ্রাণ লোকেরা এইডস বিস্তারের অন্যতম প্রধান দুটি মাধ্যম অবাধ যৌনাচার ও মাদকাসক্তি থেকে বিরত থাকেন। পক্ষান্তরে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় যৌন বিকৃতির প্রবণতা সৃষ্টি করে এবং নৈতিক পদস্খলনের কারণে বিপথগামী লোকেরা ইসলামে হারাম ঘোষিত ব্যভিচার, সমকামিতা, বহুগামিতা, মাদকাসক্তি প্রভৃতিতে প্রবৃত্ত হতে পারে। এসব কার্যকলাপ এইডস ছড়ানোর জন্য সমানভাবে দায়ী। এইডস থেকে মুক্ত থাকতে হলে এর অনুষঙ্গ থেকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। অশ্লীলতা ও অবাধ যৌনাচারে উদ্বুদ্ধ করে এমন ইসলামবিরোধী কাজ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে
এবং সব ধরনের মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত জীবন যাপন করতে হবে।
ইসলামের বিধান অনুযায়ী পারিবারিক বন্ধনে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত থাকা, নিরাপদ যৌন অভ্যাস তৈরি করে সমকামিতা ও বহুগামিতা পরিহার করে ধর্মীয় অনুশাসনে দাম্পত্য জীবন পরিচালনা করা এবং রক্ত গ্রহণ ও প্রদানকালে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করাই এইডস থেকে মুক্ত থাকার প্রধান উপায়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আনুগত্য, জীবনের প্রতি মায়া-মমতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা ও আচরণে শান্ত, কোমল, সংযত ও সংযমী হওয়া উচিত। যেহেতু শতাব্দীর ভয়াবহ এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছাড়া কার্যকর কোনো চিকিৎসা নেই, সেহেতু এইডস প্রতিরোধে নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন অনুশীলন ও ব্যাপকভাবে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে এই মরণব্যাধি রুখতে সামাজিক আন্দোলনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
জীবনের সার্বিক সুস্থতার জন্য ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধানই কার্যকর প্রতিষেধক। তাই এইডস প্রতিরোধ বিষয়ে ধর্মীয় নেতারা মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা, সেমিনার, কর্মশালা, সংবাদ সম্মেলন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জোরালো বক্তব্য দিয়ে এইডসবিরোধী বিজ্ঞাপন প্রচারণা বাড়াতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন। ধর্মীয় উপাসনালয়—মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, চার্চে শুধু শহরকেন্দ্রিক অঞ্চলেই নয়, দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এইচআইভি ভাইরাস এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে ও বোঝাতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.