কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিতে সময় নষ্ট করেননি। এ ব্যাপারে তিনি যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণের মনোভঙ্গি ত্বরিত উপলব্ধি করে তিনি সত্যিকার অর্থেই প্রাজ্ঞ জননেত্রীর পরিচয় দিয়েছেন।


বিমানবন্দর হবে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে যা ঘটে গেল তা নিয়ে কিছু ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ৩১ জানুয়ারির ঘটনা তো দুর্ভাবনারই জন্ম দেয়। ওইদিন জনরোষের যে চেহারা দেখা গেছে তা নিকট-অতীতের সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কথাই মনে করিয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে বাম সরকারের স্থানীয় নেতারা ভুল অবস্থান নিয়েছিলেন, যার মাসুল তাদের এখনো দিয়ে যেতে হচ্ছে। মেনে নিলাম যে আড়িয়াল বিল নিয়ে ৩১ জানুয়ারির ঘটনার পিছে সরকারবিরোধী বিশেষ মহলের উসকানি ছিল। নানা তথ্য থেকে এও জানা যায় যে সেদিনের ঘটনায় অনেক অর্থও ঢালা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা কেন এসবের বিরুদ্ধে সময়মতো সঠিক কাজটি করতে পারলেন না। আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের পক্ষে স্থানীয়পর্যায়ে জনমত সৃষ্টি না করে গণমাধ্যমে হম্বিতম্বি করাটা কি ঠিক হয়েছে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জেনেছি বিমানবন্দর না হওয়ার সিদ্ধান্তে স্থানীয় মানুষ মিষ্টি বিনিময় করেছেন, আনন্দ-ফুর্তি করেছেন। ব্যাপারটা তো উল্টোও হতে পারত। স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনে দিনে জনমত গড়ে তুলে সিদ্ধান্ত নিলে আনন্দ-ফুর্তিটা বিমানবন্দর নির্মাণের পক্ষেও তো হতে পারত। স্থানীয় নেতারা সে কাজটি রাজনৈতিকভাবে ঠিকমতো করতে পারেননি। আর মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোও স্থানীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশকে তোয়াক্কা না করে এমন উঠেপড়ে লাগল যে কাজটি তাড়াতাড়ি না করতে পারলে বুঝি মহাঅন্যায় হয়ে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়েছে যে স্থানীয় মানুষের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেই বোধ হয় আসল বিপত্তি। অতীতের ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে যে মতামত এবং সম্মতি না নিয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে বাঙালিমাত্রই আপত্তি তোলে। আবার যদি অতি নগণ্যের সঙ্গে আগেভাগে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে আপত্তি ওঠে না। যত নগণ্যই হোক, তার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলে কাজ হয়। এটি ভাটি অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে যাঁরা তৃণমূল মানুষের ভোটে সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী হয়েছেন তাঁরা এটি বুঝতে পারেননি। তৃণমূল মানুষ তাদের ভোট দিয়েছেন সত্য, তাই বলে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারগুলো তো আর ভোটের বাঙ্ েফেলে আসেননি। বহুদিন পর মুন্সীগঞ্জ-নবাবগঞ্জ এলাকায় আওয়ামী লীগ ভোটে জিতেছে। আমরা জানি যে আওয়ামী লীগ তৃণমূল মানুষের সংগঠন। তাই আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৃণমূল মানুষের এহেন ক্ষোভ স্বাভাবিকভাবেই ভাবনায় ফেলে।
আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে জনরোষের আন্দোলন প্রথমে স্থানীয়পর্যায়ের মনে করা হলেও ৩১ জানুয়ারির পর তা আর স্থানীয় থাকেনি। তবে মন্দের ভালো এই যে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরপরই বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া সেখানে যাননি। যদি তিনি যেতেন তবে তা হতো ঘৃতে আগুন ঢালার মতো ব্যাপার। বিএনপি এই সুযোগটি হাতছাড়া করেছে এবং সরকারও বড়সড়ো ঝামেলার মধ্যে পড়েনি। সরকারের দুই বছর পার হয়ে গেছে এবং এই দুই বছরে কোমর ভাঙা বিএনপি একটু একটু করে বেশ চাঙ্গাও হয়ে উঠেছে। তার উদাহরণ কিছুদিন আগের পৌর নির্বাচনের ফলাফল। যতই পৌর নির্বাচনকে স্থানীয় চরিত্র দেওয়া হোক, বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এই নির্বাচনের ফল তার কর্মীদের জন্য মৃতসঞ্জিবনী টনিক। এ ছাড়া হবিগঞ্জের উপনির্বাচন তাদের জন্য আশা জাগানিয়া বৈকি! যে যাই বলুক, যত হিসাব-নিকাশের কথাই উঠুক আওয়ামী লীগের ভোট যে হবিগঞ্জে কমেছে সেটাই সত্য। জাতীয় পার্টির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই, শুভঙ্করের ফাঁক যে রয়েছে হিসাব মতো অন্যখানে। মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টির নেতা এখন সরকারের বিমানমন্ত্রী। আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল অথচ তিনি অনেকটাই চুপচাপ। ঘটনার দায়িত্ব তিনি অথবা তার দল কি এড়িয়ে যেতে পারেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে বিপর্যয়ের জন্য তাঁকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা প্রয়োজন। এই পর্যায়ে আরেকটি সম্ভাব্য ঝামেলার কথা উল্লেখ করি। আড়িয়াল বিলের মতো অঘটন ঘটার পরিস্থিতি ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-বাজিতপুর অঞ্চলে বেশ কিছুদিন ধরে বিরাজ করছে। ভৈরবকে জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হলে ওই অঞ্চলের জনরোষ যে সরকারকে বিপর্যস্ত করবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভৈরব-কিশোরগঞ্জ বিরোধ ওই অঞ্চলের জনমনে তুষের আগুনের মতো গোপনে গোপনে বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বলছে। বোধ হয় তার প্রভাতও পড়েছে গত পৌর নির্বাচনেও। বিএনপি-জামায়াতীরা কি ওই অঞ্চলেও চুপচাপ বসে থাকছে। সে রকম তো মনে হয় না। এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। আড়িয়াল বিলের ঘটনায় অত্যন্ত সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে পুলিশ। দুঃখজনক সে পরিস্থিতিতে একজন পুলিশ সদস্যকে জীবনও দিতে হয়েছে। পুলিশের সহিষ্ণুতার ফলে বড় অঘটন থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা এবং প্রমাণ হয়েছে যে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও হার্ডলাইনে যেতে চাননি। নিকট ইতিহাসে শাসকগোষ্ঠীর এই ধরনের মনোভাবের উদাহরণ বিরল। শেষে বলি, আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি যা ঘটেছে তার গল্প ওই অঞ্চলের মানুষের মনে থেকে যাবে অনেকদিন। আগুন নিভেছে, তবে ছাইভস্মের আড়ালে রয়ে গেছে স্ফুলিঙ্গ। স্ফুলিঙ্গের আঁচ থেকে বাঁচতে স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতাদের আগামী দিনে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে। নইলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খবর আছে।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.