গন্তব্য ঢাকা-মন চায় এখনই গ্রামে চলে যাই by শর্মিলা সিনড্রেলা

মেঠোপথ ধরে চলে যাওয়া এলোমেলো বাঁকের পাশের গ্রামটির প্রতি এক অপরূপ টান অনুভব করেন অনেকেই। এর সঙ্গে আরও অনুষঙ্গ তৈরি করে খরস্রোতে বয়ে চলা অসংখ্য নদী। নদী আর পথ এবং পথের পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলে প্রত্যেকেরই এক মায়াময় মোহ তৈরি হয় গ্রামটির প্রতি।


নূর মোহাম্মদও এর বাইরে নন। গ্রামটির প্রতি এক অনিবার্য টান অনুভব করেন তিনিও। আর সেই গ্রামের মায়া ছাড়িয়ে ঢাকার এই রংঢং তাঁর মনে ছাপ ফেলতে পারেনি মোটেও।
বরিশালের গৌরনদীর আদুল্লা গ্রামের আলো-বাতাস মিশে আছে নূর মোহাম্মদের রক্তে। সেখানকার মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতে তিনি অভ্যস্ত। সেখানকার সুস্বাদু পানি তাঁর তৃষ্ণা মেটায়। তাই তো এসব কিছু এখনো শূন্যতা সৃষ্টি করে তাঁর মনে। ‘যখনই শ্বাস নিই তখন, যখন পানি খাই তখন, যখন বাইরের দিকে তাকাই তখন—সব সময়ই মনে হয় এই গ্রামের কথা।’ এক বছর হলো ঢাকায় এসেছেন তিনি, কিন্তু গ্রাম এখনো স্মৃতিতে অম্লান।
‘গ্রামে আমাদের জন্ম হয়েছে, গ্রামে আমরা বড় হয়েছি। সেই গ্রাম ছেড়ে আসতে কি কারও ভালো লাগে? কিন্তু ছেড়ে তো আসতেই হয়। কেননা, বাঁচতে তো হবে। গ্রামে খারাপ লাগে এমন কিছু নেই। আর এই ঢাকার কিছুই ভালো লাগে না। আমরা দুই ভাই ও দুই বোন। বাবা-মা আমাদের অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন বাবা মারা যান। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর কষ্টে-দুঃখে কোনো রকমে দিন চলত। পেটের তাগিদে কিছু করার চেষ্টা করতে থাকি। জমি-জায়গাও তেমন ছিল না। তাই একসময় মিশুক চালানো শুরু করি। কিন্তু না, এই কাজ করে আর চলে না। কেননা, মহাজনের কাছ থেকে মিশুক নিয়ে চালাতাম। নিজেদের তো মিশুক কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেই মহাজনকেই দিনের শেষে দিতে হতো ২০০ টাকা। দেখা যেত, দিনে হয়তো আয়ই করতাম ৩০০ টাকা আর তা থেকে যদি ২০০ টাকা দিয়েই দিতে হয়, তবে থাকে মাত্র ১০০ টাকা। তা দিয়ে ভালোভাবে তো দূরের কথা, কোনো রকমে বেঁচে থাকাই কষ্টকর।’ গ্রামের জীবনটা সত্যিই অনেক আকর্ষণীয় ছিল নূর মোহাম্মদের কাছে। তিনি তা ছাড়তে চাননি মোটেও। কিন্তু একসময় প্রয়োজনের তাগিদে চলে আসতে হয় এই ঢাকা শহরে। বড় ভাই নূর ইসলাম ছিলেন এই শহরে; তাই তিনি একটু সাহস পেয়েছিলেন এখানে চলে আসার।
‘আমার ওজন কত একটু দেখেন তো?’ এক যুবক এসে বললেন তাঁকে। নূর মোহাম্মদ বলে উঠলেন, ‘দাঁড়ান এই মেশিনের ওপর।’ দাঁড়ালেন যুবকটি। তারপর নূর মোহাম্মদ মেপে জানালেন তাঁর ওজন কত। এ কাজই করেন নূর মোহাম্মদ নিরবচ্ছিন্নভাবে। প্রতিদিনই সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু করেন তিনি, চলে সেই রাত ১০টা পর্যন্ত। দিনের শেষে হাতে থাকে হয়তো দেড় শ বা পৌনে দু শ টাকা। এই দিয়েই দুই ছেলে, দুই ছেলের বউ, নিজের স্ত্রী এবং ১০-১২ দিনের নাতি শাহীনের মুখে খাবার জোগাতে হয়। অবশ্য এক ছেলেও রিকশা চালায় আর বড় ছেলেটা অসুস্থ বলে কোনো কাজ করতে পারে না। ‘এই মেশিন কিনেছি চার হাজার টাকা দিয়ে। আর একটা বড় মেশিন আছে, ওটা দিয়ে লম্বা, ওজন ও শক্তি মাপা যায়। ওটার দাম তো প্রায় এক লক্ষ টাকার উপরে। না, এখন কেনার সামর্থ্য নেই সেটা, আর ঢাকায় থাকারই তো ইচ্ছা নেই। যদি একটা মিশুকও কিনতে পারি এক-দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে, তবে চলে যাব গ্রামে। বড় ভাই করেন বলেই আমি এই ব্যবসায় নেমেছি। আর মেশিনটাও তাঁরই কিনে দেওয়া।’
‘১৯৭১ সালে যখন এ দেশে যুদ্ধ, তখন আমি যুবক। যুদ্ধে আমি যাইনি, তবে অনেক মিছিল-মিটিং করেছি। এখন তো দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের কষ্ট যদিও খুব কমেনি, তাও তো স্বাধীন দেশে বাস করছি, সেটাই শান্তি।
‘রোজই সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বসি এই মেশিন নিয়ে। আর বসি এই কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাসের নিচেই। কখনো কখনো আবার বসি এশিয়া ব্যাংকের সামনে। কষ্ট যে হয় না, তা নয়। ধুলাবালিতে খুব কষ্ট হয়। মুখে মাস্ক দিয়ে থাকি সব সময়। কিন্তু আর ভালো লাগে না। ঠেইক্যা গিয়া ঢাকায় থাকি তো, তাই আর ভালো লাগে না। মনে হয়, এখনই গ্রামে চলে যাই।’ এভাবেই গ্রামে ফিরে যাওয়ার আশায় দিন গুনছেন ৬৬ বছর বয়সী নূর মোহাম্মদ। গ্রামে ফিরে যাওয়ার সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হবে তো?

No comments

Powered by Blogger.