সিলেটে বন্যা-পরিস্থিতির অবনতি, দুজনের মৃত্যু

কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেটে গতকাল বুধবার ও গত মঙ্গলবার বন্যার পানিতে ডুবে এক কিশোরী এবং এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সিলেট-বিয়ানীবাজার, সিলেট-জাফলংয়ের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।


সুনামগঞ্জ ও সিলেটের যান চলাচলও বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ছাতক-সিলেট রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
সিলেট: সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নগরের অন্তত ৫০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে সিলেট-গোয়াইনঘাট-কানাইঘাট সড়ক যোগাযোগ গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে।
গতকাল সকালে গোয়াইনঘাটের জাফলং চা-বাগানে বন্যার পানিতে ডুবে শ্রী দিবস (১৬) নামের এক চা-শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এর আগে মঙ্গলবার পানিতে ডুবে মারা যায় জৈন্তাপুরের চারিকাটা গ্রামের রুমা বেগম (৫) নামের এক শিশু। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
গতকাল নগরের শাহজালাল উপশহর, তেররতন, মেন্দিবাগ, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর, ছড়ারপাড়, যতরপুর, মাছিমপুর, কুশিঘাট, ঘাসিটুলা, কলাপাড়া, মোল্লাপাড়া, বেতবাজার, নবাবরোড, লালাদিঘীরপাড়, কুয়ারপাড়, কানিশাইল, শাপলাবাগ, শিবগঞ্জ, নাইওরপুল, কালিঘাট, মহাজনপট্টি, কাস্টঘর, কাজিরবাজার, শেখঘাট, টুকেরবাজার, কদমতলি, শিববাড়ি, আলমপুর, সাদিপুর, গোটাটিকর এলাকার কোথাও কোথাও কোমরপানি দেখা গেছে। এসব এলাকায় বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
উপশহরের বাসিন্দা সৈয়দা জ্যোৎস্না বেগম জানান, রাস্তায় কোমরপানি। সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারেননি। বাসায়ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। সিলেট পানি বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী নীহার রঞ্জন দাস জানান, সিলেট কিন ব্রিজ এলাকায় সুরমা নদীর পানি গতকাল ভোর থেকে বিপৎসীমার ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৬৫ সেন্টিমিটার এবং কুশিয়ারার পানি জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে ১ দশমিক ৭৮ সেন্টিমিটার ও বিয়ানীবাজারে শেওলা পয়েন্টে ৯৭ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটিতে বন্যা-পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩৬ হাজার ৯১০টি পরিবার। পানিতে তলিয়ে গেছে সাত হাজার ৭০ হেক্টর আউশ ফসলের মাঠ। বন্যাদুর্গত এলাকায় ৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সময়ের মধ্যে বন্যাদুর্গত এলাকায় ৫৬ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্গত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, শুকনো চিঁড়া ও বিস্কুট বিতরণ করা হয়েছে।
বিয়ানীবাজার (সিলেট): কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ায় এই উপজেলার বন্যা-পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের কাঁকরদিয়া এলাকায় প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা তলিয়ে গেছে। সিলেট-বিয়ানীবাজার বারইগ্রাম আঞ্চলিক মহাসড়কের কয়েকটি স্থান ও সুনামপুর ও শিকপুর ফেরির পন্টুন ডুবে যাওয়ায় সিলেটের সঙ্গে এই উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। দুটি স্থানে কুশিয়ারার তীর সংরক্ষণ বাঁধ ভেঙে উপজেলার দুবাগ, কুড়ারবাজার চারখাই ও মুড়িয়া ইউনিয়নের দুবাগ, কাঁকরদিয়া, আঙ্গারজুর, শেওলা, বৈরাগীবাজার, মালারগ্রামসহ অন্তত ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
ইউএনও সুব্রত কুমার দে জানান, ‘সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে আকস্মিক পানি বাড়ার ফলে কুড়ারবাজার ও দুবাগ ইউনিয়নে নদীর বাঁধ ভেঙে চারখাই, দুবাগ ও কুড়ারবাজার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে জেলা পরিষদে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’
সুনামগঞ্জ: ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ ও সিলেট সড়কে এবং দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ সড়কের কয়েক স্থানে পানি ওঠায় মঙ্গলবার রাত থেকে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া জেলার সব কটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। দোয়ারাবাজার ইউএনও কংকন চাকমা জানান, দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ সড়ক প্লাবিত হয়ে কয়েক জায়গা ভেঙে গেছে। উপজেলায় ১২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ।
ছাতকের ইউএনও সুজিত কুমার রায় জানান, উপজেলার প্রধান সড়ক প্লাবিত হওয়ায় এই উপজেলার সঙ্গে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ছাতক-সিলেট রেললাইন ডুবে গেছে। তাই রেল যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নই বন্যাকবলিত। এর মধ্যে ইসলামপুর ও কালারুকা ইউনিয়নের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। সুনামগঞ্জ শহরের নীবনগর, মাছবাজার, পশ্চিমবাজার, ওয়েজখালী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী ডলুরা এলাকায় মঙ্গলবার রাতে ঢলের পানিতে ৪০টি কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্র জানিয়েছে, সুনামগঞ্জে নদীর পানি গতকাল বেলা তিনটার দিকে বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
গোয়াইনঘাট (সিলেট): গোয়াইনঘাট উপজেলার বন্যা-পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। টানা বর্ষণ থেমেছে। তাই গতকাল নতুন করে পানি বাড়েনি। কিন্তু অনেক এলাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় জনদুর্ভোগ কমেনি।
স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা গতকাল বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। এদিকে পর্যটনকেন্দ্র জাফলং এলাকায় বন্যার পানি কমেনি। সিলেট থেকে জাফলংয়ের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় জাফলং পর্যটনশূন্য হয়ে পড়েছে। জাফলং ও বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারির পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় কয়েক হাজার শ্রমিক তিন দিন ধরে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
ইউএনও মো. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী জানান, ‘আমার বাসভবনের পানি এখনো নামেনি। এদিকে বিতরণ করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবারও পাচ্ছি না। তবে যা পেয়েছি বা পাচ্ছি, তা ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য বণ্টন করে দিচ্ছি।’
কুড়িগ্রাম: দুধকুমার, গঙ্গাধর, ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল সকালে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে গেছে, জেলা সদর, চিলমারী, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, রৌমারী, রাজীবপুর, রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার শতাধিক চর, দ্বীপচর ও নদীসংলগ্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শতাধিক চরের ৪০ সহস্রাধিক মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, আমন বীজতলা, পাট ও সবজির খেত।
উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবল স্রোতের চাপে হাতিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। বাঁধ ভেঙে গেলে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে।
কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউপির চেয়ারম্যান আমীর হোসেন জানান, জেলা শহর লাগোয়া ধরলা সেতুর কাছে কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কটির কাছ ঘেঁষে প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে সড়কটি বিলীন হয়ে ওই এলাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.