চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয়-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবানসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের আরো কয়েকটি জায়গায় প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ৯০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। উদ্ধার তৎপরতা চলছে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে।


কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের অনেক এলাকাই এখন বন্যাকবলিত। চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ডুবে যাওয়ায় বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ভাটিয়ারিতে রেলসেতু ধসে যাওয়ায় ট্রেন চলাচলও বন্ধ রয়েছে। এক দিন পর ভাঙা সেতুর আগে ও পরে বিকল্প ব্যবস্থায় ট্রেন চালু করা হলেও পরিবহন সমস্যায় মানুষের ভোগান্তি অনেক বেড়ে গেছে। এদিকে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রমও বন্ধের উপক্রম। অন্যদিকে সিলেটের চারটি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত। উত্তরাঞ্চলের যমুনা অববাহিকায় ভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে দেশ এক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে, যা অনেকাংশেই আমাদের দীর্ঘ উপেক্ষার ফল।
চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনা তো নতুন নয়। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে মারা যায় ১২৮ জন। ২০০৮ সালে মারা গেছে ৮৬ জন। প্রতিবছরই মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ধস রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। বরং অনৈতিক ও লোভী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পাহাড়ধসকে আরো উস্কে দেওয়া হয়েছে বলেই তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ পাহাড় কাটা। কিন্তু তা বন্ধ হয়নি। প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিনিয়তই পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি। দেখেছি, কোথাও কোথাও জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিংবা অন্যান্য সংস্থা নিজেরাই পাহাড় কাটছে বা কাটাকে উৎসাহিত করছে। আবার গরিব মানুষরা কম খরচে থাকার জন্য কাটা পাহাড়ের নিচে গড়ে ওঠা বস্তিগুলোয় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ পাহাড় একেবারেই ন্যাড়া, কোনো গাছপালা নেই। ফলে কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টি উপরিভাগের মাটি নরম করে দেয় এবং একসময় তা ধসে পড়ে। ন্যাড়া পাহাড়গুলোকে সবুজ আচ্ছাদনে ছেয়ে দেওয়া কি অসম্ভব কোনো কাজ ছিল? কিন্তু প্রশাসন সে কাজটি করতে পারেনি। পাহাড়ের পাশে থাকা বসতিগুলো রক্ষায় কংক্রিটের শক্ত দেয়াল তৈরি করা যেত। তাও করা হয়নি। এমনকি কেউ যাতে বিপজ্জনকভাবে বস্তি বা ঘরবাড়ি তৈরি করতে না পারে, সে ব্যবস্থাও করা হয়নি। তাই এই পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনায় আমরা অবশ্যই প্রশাসনকে দায়ী করব এবং নিন্দা জানাব।
অন্যদিকে জালের মতো জড়িয়ে থাকা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অনেক নদীই ইতিমধ্যে মরে গেছে। বাকি নদীগুলোরও অধিকাংশই আজ মৃতপ্রায়। কিন্তু উজান থেকে আসা ঢলের পরিমাণ প্রায় একই রয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে পরিমাণ পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই আসে উজান থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পানি মৃতপ্রায় নদীগুলো ধারণ করতে পারে না। তখন বন্যা হয়ে পড়ে অবধারিত, ভাঙন হয় তীব্রতর। ব্রিটিশ-ভারতেও নিয়মিত নদী খননের আয়োজন ছিল। অথচ তদানীন্তন পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের চার দশকে নদী খননের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। কাজেই একে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা কি ঠিক হবে? যত ব্যয়বহুলই হোক, দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হলে নদীগুলোকে বাঁচাতেই হবে।
একদিকে পাহাড়ধস, অন্যদিকে বুক সমান জলাবদ্ধতা- এর মাঝে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বন্যা, নদীভাঙন, পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতার অসহায় শিকার মানুষজনের দুর্দশা লাঘবে সরকার সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। পাশাপাশি বন্যা-পরবর্তী অসুখ-বিসুখ মোকাবিলায় এখন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.