বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধস ও বজ্রপাতে নিহত ৮৫-পাহাড়ে পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল

পাহাড়ি লাল মাটি সরিয়ে বের করা হচ্ছিল একের পর এক লাশ। যেন মৃত্যুর মিছিল। বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ে পাহাড়ে গতকাল বুধবার দেখা গেছে এমন দৃশ্য। গত মঙ্গলবার রাতের পাহাড়ধস প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই তিন জেলার ৭৮ জনের।


চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বজ্রপাতে মারা গেছে আরও ছয়জন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে দেয়ালধসে মারা গেছে এক স্কুলছাত্রী।
অবশ্য, গতকাল বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) সংবাদে ওই তিন জেলায় মৃতের সংখ্যা ৯৪ জন উল্লেখ করা হয়। তবে সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, গত কয়েক দিনের অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ধসে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে ৯১ জন মারা গেছে। নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সাহায্য দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন দল উদ্ধার-তৎপরতা চালায়।
বান্দরবানে নিহত ৩৬: বান্দরবানে পাহাড়ধসে ৩৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের রাইম্যাখোলায় একই পরিবারের সাতজন ও অতিথিসহ ১১ জন নিহত হয়। পাশের মংনমা পাড়া ও পুকখাইয়াঝিড়িতে ১৩ জন এবং রূপসী পাড়া ইউনিয়নে একই পরিবারের তিনজন মারা গেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দক্ষিণ বাইশারীতে ছয়জন, দোছড়িতে এক শিশু ও উপজেলা সদরে দুজন মারা গেছে।
জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে রাইম্যাখোলায় ছোট-বড় অনেক পাহাড় ধসে পড়েছে। রাইম্যাখোলার বাসিন্দা রাহেলা বেগম ও জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে জানান, মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে প্রবল বর্ষণের সময় প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন, পশ্চিম পাশের পাহাড় ধসে আবদুস সালামের বাড়ির ওপর পড়ে। ওই মাটি রাস্তা পর্যন্ত আসে। লোকজন সালামের স্ত্রী নাসিমা বেগমকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। তাঁদের সাত বছরের মেয়ে শাহানা বেগমকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। হাসপাতালে নাসিমার মৃত্যু হয়।
একই এলাকায় দুটি পাহাড় ধসে পড়ে নূরুল ইসলামের বাড়ির ওপর। প্রতিবেশী আক্তার হোসেন জানান, সকালে ওই বাড়ি থেকে ১১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁরা হলেন: নূরুল ইসলাম (৪০), তাঁর স্ত্রী রাশিদা খাতুন (৩০), মেয়ে শাহিমা সুলতানা (১২), রেহানা আক্তার (১০), তাহসিনা আক্তার (১০), আবু হানিফ (৬) ও এনি আক্তার (৪), অতিথি নাজিম উদ্দিন (২০) ও বশির আহমদ (৫০)। অপর দুই নারী অতিথির পরিচয় জানা যায়নি।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জানান, দক্ষিণ বাইশারীতে পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে মাটির ঘর ধসে একই পরিবারের ছয়জন নিহত হন। তাঁরা হলেন: রুহুল আমিন (৪০), তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৩২), ছেলে সুফি আলম (৬) ও মোর্শেদ আলম (৩), মেয়ে পারভিন আক্তার (৫) ও রোকেয়ার মা হাসিনা বেগম (৭০)। সদর ইউনিয়নের বাগানঘোনা গ্রামে পাহাড়ধসে মারা যান আরমান (৫), মোহামঞ্চদ আলী (৩০) ও আবদুল হক (৭)।
ফাইতংয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশ কেটে ছোট ছোট ধানি জমি করা হয়েছে। এ ইউনিয়নে অনেক ইটভাটা রয়েছে। এলাকাবাসী বলেন, ইটভাটার কাঠের জন্য বন উজার হওয়ায় পাহাড়গুলো ন্যাড়া হয়ে গেছে। পাহাড়ধসের এটিও একটি কারণ।
বান্দরবানে মৃত্তিকা গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ফাইতংয়ে ইটভাটায় বনের গাছপালা ও পাহাড়ির মাটির ব্যবহার, লোকজনের ভুল চাষাবাদসহ নানা কারণে পাহাড়গুলো গরমের দিনে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে ফাটল ধরে। বর্ষার সময়ে ওই ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করে ধস নামতে পারে। এ ছাড়া পাহাড়ের গোড়া কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করলে ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
জেলা প্রশাসক এ কে এম তারিকুল ইসলাম ৩৬ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ১০ লাখ টাকা ও ২২ টন খাদ্যশস্য দেওয়া হচ্ছে।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা ফাইতংয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে বলেন, কী কারণে এ বিপর্যয়, তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে নিহত ২৬: চট্টগ্রাম নগরের তিনটি স্থান, বাঁশখালী ও সীতাকুণ্ডে পৃথক পাহাড়ধসে ২২ জন নিহত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত থেকে নগরের আকবর শাহ মাজারের কাছের পাহাড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে ছয়জন, উত্তর পাহাড়তলীর মটকাঘোনা থেকে ছয়জন ও বিশ্বকলোনি থেকে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেছি। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় পাঁচজনকে। এ ছাড়া বাঁশখালীর শিলকূপে তিন ভাইবোন ও সীতাকুণ্ডের ছলিমপুরে পাহাড়ধসে দুজন মারা গেছে।’
নিহত ব্যক্তিরা হলেন: আকবর শাহ মাজার এলাকার ইয়াসিন কলোনির শানু (১৮), তাঁর ভাতিজি উর্মি (৩), হাসনা বানু (২৮), সাবিনা (২৪), তাঁর মেয়ে আসমানি (১) ও ছেলে সজীব (৪); মটকাঘোনার রাবেয়া বেগম (৩৫), জানু আক্তার (৩৫), সুবর্ণা (১৮), তাজনিন (৬), কুলসুম (৭) ও ফাতেমা (৮); বিশ্বকলোনির হাবরাতলীর আজহার আলী (৭২), রমজান আলী (২৮), মাসুদ (২), রাফিয়া (৫৫) ও কুলসুম (৯)। জানা গেছে, তাঁদের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে।
সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুরে পাহাড়ধসে নিহত ব্যক্তিরা হলেন: শামসুল আলম (৪০) ও তাঁর ছেলে মোহাম্মদ ইয়াসিন ফরহাদ (৬)। তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার জারিকান্দি গ্রামে।
বাঁশখালীর জঙ্গল শিলকূপে নিহতরা হলো: মিনহাজুর রহমানের ছেলে শহীদুল ইসলাম (১২) ও দুই মেয়ে খোরশেদা (৮) ও ফাতেমা (৪)।
এ ছাড়া সাতকানিয়া উপজেলায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বজ্রপাতে ছদাহা মাইজপাড়া গ্রামের মোহামঞ্চদ ফারুক (১৩) ও তার বোন মণি আকতার (১০) এবং সাতকানিয়া সদরের জানে আলমের ছেলে মাসুদ আলম (৮) মারা যায়।
একই সময় হাটহাজারী উপজেলার চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া হাজীপাড়ায় প্রবল বর্ষণের সময় একটি বাড়ির সীমানাদেয়াল ধসে বিবি কাউসার (১৫) নামের স্থানীয় কেসি গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী মারা যায়।
কক্সবাজারে ২৩ জন নিহত: কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের খেওয়াছড়ি সোনারঘোনায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত একটার দিকে পাহাড়ধসে সাতজন মারা যায়। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর রত্নাপালং ইউনিয়নের ভালুকিয়া আমতলী বিজিবি ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ধসে তিনজন মারা যায়। হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন ও রত্নাপালং ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল কবীর চৌধুরী নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন: ভালুকিয়া আমতলী গ্রামের সোনা আলীর স্ত্রী গোল মেহের (৫০), দুই মেয়ে শামসুন নাহার (২০) ও রোজিনা আক্তার (১৫), খেওয়াছড়ি সোনারঘোনার ফরিদ আলম (৩০), তাঁর মা গুলশানা বেগম (৫০), বোন সালেহা বেগম (১২) ও ছেলে ইলিয়াছ (৩), ভুলু মিয়ার স্ত্রী আয়েশা বেগম (৩০), ছেলে হেলাল উদ্দিন (৭) ও মোক্তার আহমদের মেয়ে সাদিয়া বেগম (৩)।
পাহাড়ধসে গুরুতর আহত হন সোনা আলী (৬০), তাঁর ছেলে বদি আলম (১৭) ও বড় মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)।
চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের বাইগ্যারঘোনা গ্রামে মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে পাহাড়ধসে পাঁচজন নিহত হন। তাঁরা হলেন: আবুল খায়েরের স্ত্রী মরিয়ম খাতুন (৩৩), মেয়ে শিখা আক্তার (৭), ছেলে মইন উদ্দিন মামুন (৫) এবং বদি আলমের ছেলে আবু তালেব (২৬) ও আসাদুল ইসলাম (৬)।
হারবাং ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুদ্দিন বাবর জানান, সকালে লাশগুলো উদ্ধার করে দাফন করা হয়।
উপজেলার বরইতলী ইউপির চেয়ারম্যান জিয়া উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার রাতে তাঁর ইউনিয়নের মোড়াপাড়া গ্রামে বজ্রপাতে ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান নুরুল ইসলামের স্ত্রী জোবাইদা বেগম (২০) ও ছেলে আবু বক্কর (১০)।
জেলার রামু উপজেলার কাউয়ারকূপ ইউনিয়নে পাহাড়ধসে পাঁচজন মারা গেছেন। তাঁরা হলেন: মধ্যম কাউয়ারকূপ গ্রামের নজির আহমদ (৪০), তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৩০), মেয়ে রোকেয়া বেগম (৩) ও খুকু মণি। সকালে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। একই সময়ে পশ্চিম কাউয়ারকূপ গ্রাম থেকে কবির আহমদের (৪৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। ইউনিয়নের মোষকুম গ্রামের মোহামঞ্চদ কালুর এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী তিন শিশুসন্তান রাতে পাহাড়ি ঢলে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের বানিয়াকাটা গ্রামে বজ্রপাতে খোরশেদ আলম (৩৫) মারা যান।
ঘরবাড়ি বিলীন: নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ বলেন, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানির কারণে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের সঙ্গে বাইশারী, ঘুমধুম, দোছড়ি, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তিন হাজারের বেশি বসতবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত। ঢলে পাঁচ শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। প্রায় ২০০ পরিবারকে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের স্কুল-কলেজে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজার সদর, রামু ও চকরিয়া উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০০ গ্রামের অন্তত চার লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ কিছু কমলেও দুর্গত এলাকায় খাবার ও পানীয় জলের তীব্র সংকট চলছে।
টানা বর্ষণে খরস্রোতা লোগাং নদীর অব্যাহত ভাঙনে গতকাল বেলা তিনটা থেকে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার পানছড়ি-দুধুকছড়া সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এক কোটি টাকা এবং ১,৪৫০ টন চাল বরাদ্দ: অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য সাহায্য হিসেবে এক কোটি টাকা ও এক হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। গতকাল খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ থেকে এ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২০ লাখ টাকা ও ৩০০ টন চাল, কক্সবাজারে ৩০ লাখ টাকা ও ৫০০ টন চাল, বান্দরবানে ১০ লাখ টাকা, সিলেটে ১০ লাখ টাকা ও ২৫০ টন চাল, ফেনীতে পাঁচ লাখ টাকা ও ৫০ টন চাল, নেত্রকোনায় দুই লাখ টাকা, ভোলায় দুই লাখ টাকা, পিরোজপুরে দুই লাখ টাকা ও ৫০ টন চাল, হবিগঞ্জে পাঁচ লাখ টাকা, মৌলভীবাজারে পাঁচ লাখ টাকা ও ২০০ টন চাল, গৃহনির্মাণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা এবং মানিকগঞ্জে চার লাখ টাকা ও ১০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রণব বল, চট্টগ্রাম; আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার; বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, বান্দরবান; রতন কান্তি দে, উখিয়া; রুহুল বয়ান, মহেশখালী; মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, হাটহাজারী এবং নতুন ধন চাকমা, পানছড়ি]

No comments

Powered by Blogger.