বন্য প্রাণী সংরক্ষণ-বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে হাঁক, দ্বিগুণ হবে বনের বাঘ by খসরু চৌধুরী

মাস কয়েক আগে বন বিভাগের আমন্ত্রণে উপস্থিত হই বিশ্বব্যাংকের ঢাকার আঞ্চলিক অফিসে। শুনেছিলাম সেখানে বাঘ নিয়ে আলোচনা হবে। গিয়ে শুনলাম অনুষ্ঠানের আয়োজক বিশ্বব্যাংক। দেখলাম, অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন বন বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের কর্মকর্তারা, কয়েকজন বাঘ গবেষক, বিশ্বব্যাংকের


বাঘবিষয়ক উপদেশকসহ আরও জনা কয়েক। আলোচনার বিষয়বস্তু আগেভাগে জানতাম না। বিশ্বব্যাংকের উপদেশক আমার অজ্ঞতা দূর করে আলোচনার শুরুতেই জানালেন, বিশ্বব্যাংক পরিকল্পনা নিয়েছে আগামী এক যুগের মধ্যে বন্য বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার। সেটা করার জন্য কর্তব্যকর্মে আমাদের কিঞ্চিৎ বিনা পয়সার উপদেশ চান তাঁরা।
বহুকাল ধরে বাঘ নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করে আসছি। এমন অপ্রত্যাশিত শুভ সম্ভাবনায় আর একটু হলে বাহ্ বাহ্ বলতে বলতে লাফ দিয়ে উঠতাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখি, আমি ছাড়া এখানে আর কোনো সাংবাদিক নেই। এখনকার পৃথিবীর অর্থনৈতিক ধর্মকর্ম হচ্ছে, প্রচারেই প্রসার। এই প্রচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে প্রচারমাধ্যমের। অথচ প্রচারমাধ্যমকেই এই অভাবিত সম্ভাবনার সূচনালগ্নে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মুহূর্তেই বিশ্বের ১৩টি বাঘ-দেশের জমকালো প্রাণীটির বর্তমান বাসস্থানের ছেঁড়াখোঁড়া মানচিত্র মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল। ভেসে উঠল বাঘের চৈনিক ঐতিহ্যগত ঔষধির তীব্র চাহিদা মেটাতে ১৩টি দেশেরই বুনো বাঘের জঙ্গল বাঘশূন্য হয়ে চলেছে, জঙ্গল কেটে কৃষিজমি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে—এসবের চলচ্চিত্র। ১৯৬০ সালের দিকে বিশ্বের বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন, বাঘ হয়তো একবিংশ শতাব্দী দেখতে পাবে না। ১৯৭২ সালে বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলের আগ্রহে ভারত সরকারের সুবিবেচনায় বাঘ প্রকল্প চালু হওয়ার পর একে একে অন্য বাঘ-দেশগুলোও প্রকল্প প্রণয়নে যোগ দিলে ব্যাঘ্রকুল আপাতত বিলীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় এবং একবিংশ শতাব্দীর সূর্যোদয় দেখতে পাচ্ছে। তবে এই দর্শন ছানিপড়া চোখের।
বিশ্বব্যাংক যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই ছানি কাটার দায় হাতে তুলে নিচ্ছে, তাতে আমাদের আহ্লাদিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাঘ রক্ষার এই পরাজিত মহাযুদ্ধে আমরা যারা তিক্তপ্রাণ আহত সৈনিক, বিশ্বব্যাংকের এই উদ্যোগে তাদের মনের মধ্যে কু গাইতেই পারে। হয়তো আমার মনে পাপ আছে বলেই কু গাইছে। হঠাৎ বিশ্বাস হতে চায় না। কারণ বুনো বাঘের বর্তমান ‘স্টক’ই রক্ষা করা যাচ্ছে না, সেখানে দ্বিগুণসংখ্যক বাঘ রাখার বাস্তু কোথায়!
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন চিন্তা করি, যে বাংলাদেশি শিশুটি আজ জন্ম নিচ্ছে, তার মাথায় প্রথম যে শিরোপা পড়ছে, সেটি হচ্ছে ১৫৩ ডলার বা ১০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা। এই ঋণের অর্ধেকটারই মহাজন বিশ্বব্যাংক।
বেশ তো সরকারকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ‘প্রেসক্রাইবড প্রজেক্ট’ গিলিয়ে চক্রবৃদ্ধি সুদের কারবার চালাচ্ছিল বিশ্বব্যাংক। হঠাৎ বাঘের মতো দেয়ালে হাঁড় ঠেকা প্রাণীটির ওপর সুদৃষ্টি পড়ার বুদ্ধি তাদের মাথায় কে ঢোকাল? এখানে লভ্যাংশের শুরুটা কোথায়? ঋণ চাপবে কী পরিমাণ? বিশ্বব্যাংক এলেই এরা নিযুক্ত করবে একদল ‘কনসালট্যান্ট’ নামক একশ্রেণীর অযোনিজ অবতার বাহিনীকে। এঁরা সর্বজ্ঞ মহামহোপাধ্যায় ব্যক্তিবর্গ; এঁরা এসে আগেই কাটা ছকে দেশের বাঘের জঙ্গল আঁটাবেন। তারপর সরকারকে ঋণসহ পরামর্শ দেবেন কী করতে হবে। প্রকল্পের টাকা ফুরালে এঁরা হবেন পগারপার, আমরা পাব কিছু চর্বিতচর্বণ কাগজপত্র, এঁদের ফেলে যাওয়া যানবাহন, বাসস্থানের উত্তরাধিকার। কাণ্ডগুলো ঘটবে ওই বনভূমিকে উপলক্ষ করেই, যার ৭০ শতাংশ এখনো গাছপালা আচ্ছাদিত। পাঠক, আগেই কবুল করেছি, আমার পাপী পামর মন বলেই অবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়েছে। হয়তো সত্যিই একটা শুভ, ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশই উপহার দিতে চায় বিশ্বব্যাংক।

২.
বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হলে এই প্রাণীটির আবাস ফিরিয়ে দেওয়ার যে কর্মযজ্ঞে হাত দিতে হবে, বিশ্বব্যাংককে তার সামান্য ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। রাশিয়া ও চীন ছাড়া বাঘ-অধ্যুষিত ১১টি দেশের অবস্থান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বিগত ৫০ বছরে এ এলাকার সব কটি দেশই স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে হতক্লান্ত। অধিকাংশ দেশই এখনো বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী নিয়ে বিব্রত। বিশ্বব্যাংকের কনসালটেন্টরা ফরাসিদের মতো যেকোনো বিষয়কে একটি গালভরা নাম দিতে পছন্দ করেন। এই এলাকাগুলোকে তাঁরা প্রথমে নাম দিয়েছিলেন ‘হাঙ্গার বেল্ট’। এখন বলে থাকেন ‘এশিয়ান সফট বেলি’। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, আগামী ৪০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা দেড় গুণ বেড়ে পৌঁছাবে নয় বিলিয়ন আদমসন্তানে। এর উদ্বৃত্ত দেড় বিলিয়নই জন্মাবে এসব দারিদ্র্যপীড়িত দেশে। গত ৬০ বছরে এসব এলাকার ৬৫ শতাংশ বনভূমিই নষ্ট অথবা কৃষিভূমিতে পরিণত হয়েছে। যে এলাকাগুলো এখনো জঙ্গলাকীর্ণ, সেগুলোও দুই-তৃতীয়াংশ বিক্ষিপ্ত বনে পরিণত হয়েছে। এ উপাত্ত এফএওর। এমনকি রাশিয়ায়, যে দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বন এলাকা রয়েছে, সেখানেও ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এক লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার (বাংলাদেশের সমান) বনভূমি কেটে ফেলা হয়েছে। এর অধিকাংশই দূরপ্রাচ্যের—সাইবেরীয় বাঘের দেশের। এই খুবলে নেওয়া মানচিত্রে ছুৎমার্গগ্রস্ত বামুনের মতো কোনো রকমে টিকে আছে সাড়ে তিন হাজারের মতো বাঘ।

৩.
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে আয়োজিত সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি বাঘের জন্য যেমন আশাব্যঞ্জক, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। এবার সাংসদ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বন বিভাগ বাঘ সংরক্ষণে আরও মনোযোগী হবে আশা করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, বাঘ সংরক্ষণ তাঁর রক্তের ঋণ। সরকারি পর্যায়ে এ দেশে বাঘ সংরক্ষণে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বে বাঘ সংরক্ষণের প্রথম প্রবক্তা ব্রিটেনের রাজপরিবারের আত্মীয় গাই মাউন্টফোর্ট ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় দেখা করে বাঘ সংরক্ষণে তাঁকে উৎসাহিত করেন। মাউন্টফোর্টের ভাষ্য অনুসারে, বঙ্গবন্ধু বাঘসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী রক্ষায় অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে অঙ্গীকার করেন (সেভ দ্য টাইগার: গাই মাউন্টফোর্ট)। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩-৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রথমবারের মতো প্রণয়ন করা হয়। বাঘ শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুন্দরবন থেকে বাঘের বাচ্চা এনে ঢাকা চিড়িয়াখানায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। বাঘটি প্রায় ১৫ বছর চিড়িয়াখানায় বেঁচে ছিল। এরপর ঢাকা চিড়িয়াখানায় আর কোনো সুন্দরবনের বাঘ ঢোকেনি।
রক্তের ঋণের প্রসঙ্গটা সে জন্যই।
বিশ্বব্যাংকের এই উদ্যোগে চীন, ভারত, রাশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো উপকৃত হবে। কারণ, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারাও অর্থনৈতিকভাবে অংশ নিতে পারবে। বিশ্বব্যাংকের খবরদারি সেখানে খাটবে না। সেটা মজুদ থাকবে আমাদের মতো নড়বড়ে আর্থিক সংগতির দেশগুলোর জন্য। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে সরকার বাঘ রক্ষার জন্য একটি তহবিল খুলে প্রচারণা চালাতে পারে। এতে প্রবাসীসহ দেশবাসী নিশ্চয়ই সাড়া দেবে। সমাজের বিত্তবানেরাও এগিয়ে আসবেন। সেই সঙ্গে একটি লটারির আয়োজন করলে একই সঙ্গে অর্থসমাগম এবং ঘরে ঘরে পৌঁছানোর মতো প্রচারণাও হবে। বাঘ সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় অস্ত্র জনগণের অংশগ্রহণ, সেটাও আংশিকভাবে সম্পন্ন হবে। দেশে বাঘ বিষয়ে প্রশিক্ষিত বেশ কয়েকজন জীববিজ্ঞানী আছেন। তাঁরা সুযোগ পেলে অবতারদের চেয়ে অনেক কম অর্থে অনেক অর্থপূর্ণ কাজ করতে পারবেন, সে বিশ্বাস আমার আছে। আর এই সংগতিতে বিশ্বব্যাংকও আচরণে অনেক যত্নবান হবে।

৪.
বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার বিশ্বব্যাংকের মতামত একটি স্লোগান মাত্র।
বাঘ কত বাড়বে, সেটা নির্ভর করে জঙ্গলের ধারণক্ষমতার ওপর। বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে বড় কর্তব্য হচ্ছে বর্তমান সংখ্যা ধরে রাখা। দেশে সুন্দরবন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঝেমধ্যে দু-চারটি বাঘ কিছুকাল অবস্থান করে। তাদের ‘জেনেটিক’ ভবিষ্যৎ নেই। ভরসা একমাত্র সুন্দরবনের বাঘ। ঢাকায় বসে আমরা যতই বাঘের মাঙ্গলিক আলোচনা করি, তাতে বাঘের কিছুই আসবে-যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সুন্দরবনের আশপাশে বসবাসকারী জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। তাদের বননির্ভরতা কমাতে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা বিবেচনা করা প্রাথমিক করণীয়। সুন্দরবনে মাঠপর্যায়ে বন বিভাগের যে কর্মচারীরা কর্মরত আছেন, তাঁদের ঝুঁকিভাতা, বাসস্থান উন্নয়ন, যোগাযোগ-নিরাপত্তার উন্নয়ন আবশ্যকীয় কর্তব্য। সুন্দরবন এখন পুরোপুরি ডাকাতদের দখলে। বাঘ সংরক্ষণের প্রথম কাজই হলো পুরো বন এলাকা সরকারি দখল তথা আইনের আওতায় আনা।
বন নিরুপদ্রব থাকলে বাঘ এমনিতেই বাড়বে।
খসরু চৌধুরী: লেখক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.