রাজধানী-ঢাকা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে by উম্মে মুসলিমা

পৃথিবীর সব দেশের রাজধানী বা মেগাসিটির চরিত্র কমবেশি এক রকম। খুশবন্ত সিংয়ের ‘দিল্লি’ এর অন্যতম উদাহরণ। রাজধানী কারও নিজস্ব নয়। রাজধানীতে প্রায় সবাই উদ্বাস্তু। নিজের শেকড় গ্রামগঞ্জে, মফস্বলে। ঈদ-পার্বণের ছুটিছাটায় ঢাকার চেহারা দেখলেই ঢাকায় বসবাসরত মানুষের আসল রূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
একবার যুব মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ভারত থেকে একটি যুবদল এসেছিল কোরবানি ঈদের মধ্যে। ঢাকা তখন ফাঁকা। ঢাকার পরিচ্ছন্ন জনবাহুল্যহীন স্বল্প যানবাহনের শব্দহীন পরিবেশ ওদের মুগ্ধ করেছিল। ওরা বলেছিল, ঢাকা পৃথিবীর সেরা রাজধানী। ওদের বাংলাদেশি কাউন্টারপার্টরাও এমন কিছু ভেঙে বলেননি। কেবল কোরবানির ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সব ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখিয়ে ওদের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন।
ঢাকা দিনদিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে বাসযোগে গাবতলী এসে পৌঁছাতে যদি পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে, গাবতলী থেকে গুলিস্তানে পৌঁছাতে আরও পাঁচ ঘণ্টা লাগে। কী অবস্থা! সুউচ্চ বিল্ডিং থেকে নিচের রাস্তায় তাকালে দেখা যায়, যানবাহন মাইলকে মাইল স্থির হয়ে আছে। মঙ্গা, খরা, নদীভাঙন এলাকা থেকে প্রতিদিন আসা দরিদ্র মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে রিকশা। ট্রাফিক আইন না জানা এসব রিকশাওয়ালার অজ্ঞতায় যানজটে ভজঘট রাজধানী। ওসব অঞ্চল থেকে আসা নারীরা পোশাক কারখানায় ঢুকে পড়ছেন। ঢাকা শহর ছাড়া এত কর্মসংস্থান আর কোথায় আছে? কবি বলেছেন, ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে তবে একটি দিয়ে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।’ আর আমাদের ঢাকাবাসীর দুটি পয়সা জুটলে একটি দিয়ে আমরা ১০০ গজ দূরের গন্তব্যেও রিকশায় উঠি। ফুটপাতে গৃহহীন মানুষ দিব্যি পলিথিনের ঘরে বংশবৃদ্ধি করে চলেছেন। অন্যদিকে ধনী লোকজনের বাসায় প্রতিটি সদস্যের জন্য একটি করে গাড়ি। সবুজ ধ্বংস করে চারদিকে অপরিকল্পিত অট্টালিকা। মেগা শপিংমলগুলো সিংহভাগ বিদ্যুৎ খেয়ে নিচ্ছে। কারখানার বর্জ্যে নদীর পানি বিষাক্ত। প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টারে আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করছে। সাধারণ জনজীবন ছিনতাই, ডাকাতি,
সন্ত্রাস, নৃশংসতায় বিপর্যস্ত। পরিবেশবিদেরা গভীর আতঙ্কে আছেন এই ভেবে যে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকা শহর অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাসের প্রত্ননগরে পরিণত হতে যাচ্ছে।
নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু হব হব করেও সেই বীজের অঙ্কুরোদ্গম হচ্ছে না। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে যে দুই ধরনের স্থাপনা ঢাকা থেকে অচিরেই সরানো জরুরি, সেগুলো হচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান। আইন করে এই দুটোর স্থাপনা নিষিদ্ধ করা হলে ঢাকার ওপর আপনাআপনিই চাপ কমে যাবে।
ঢাকা শহরের বেশির ভাগ মানুষই চাকরিজীবী। ছোট-বড় ব্যবসায়ীও আছেন। অনেকে চাকরিকালীন নিজস্ব ঠিকানার জন্য ফ্ল্যাট বুকিং দিচ্ছেন। কেউ কেউ ভৌতিক উপায়ে চাকরিজীবনের শুরুতেই কিনে ফেলছেন। কেউ প্লট কিনে রাখছেন ভবিষ্যতের জন্য। কেউ অবসরের পর পেনশনের টাকার পুরোটা বিনিয়োগ করছেন একটা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য। ঢাকা পক্ষ বিস্তার করছে আশুলিয়া, নবীনগর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জতক। ঢাকার একখণ্ড জমি হীরার টুকরো। ওদিকে জেলা বা উপজেলা শহরের উচ্চাভিলাষী মানুষ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালো লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় জমি কিনতে শুরু করেছেন। ঢাকা নাকি ঝাকানাকা। সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, আবহাওয়াবিদ, বিজ্ঞানীরা রীতিমতো শঙ্কিত। ঢাকাকে এখন রাখা দায়।
তাই যে কথাটা বলার জন্য এত অবতরণিকার ভণিতা, সেটা হচ্ছে, কেন ঢাকা শহরেই থাকতে হবে? বিশেষ করে যাঁরা চাকরিজীবন শেষ হওয়ার সময় রাজধানীতে একটা আপন ঠিকানার চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁরা কি জীবনের কটা দিন একটু দূষণমুক্ত, নিরিবিলি, কোলাহলমুক্ত জীবন পেতে পারেন না? অনেকে হয়তো বলবেন, ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, নিজেদেরও বয়স বাড়ছে। কে দেখবে তাঁদের গ্রামগঞ্জে ফিরে গেলে? কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে কেউ কি আর সেভাবে সময় দিতে পারে? আর সবাই যে ঢাকাতেই থাকবেন, তারও তো কোনো মানে নেই। ছেলেমেয়েদের অনেকেই বিদেশে চলে যাচ্ছে। হয়তো বলবেন, ওদের জন্য ঢাকায় একটা ঠিকানা করে দিতে হবে না? বরং ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত ও প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেন। ওরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নেবে। যেসব বাবা-মা সন্তানদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান রেখে যান, সেসব সন্তান নিজেদের উন্নতির জন্য চেষ্টা কমই করেন। শেষ পর্যন্ত সেই কেনারাম-বাবুরাম-বেচারামের ধারাবাহিকতার শিকার হয়ে পড়েন তাঁরা। বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটসও সন্তানদের জন্য সম্পত্তি রেখে যাওয়ার পক্ষপাতী নন।
অনেকে এ রকমও ভাবছেন। তিন ভাই আর এক বোন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় থাকেন। তাঁদের কারও ছেলেমেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, কারও কলেজে, কারও স্কুলে। তাঁরা ভাবছিলেন, ঢাকা শহরে ভাইবোন মিলে প্লট কিনে ফ্ল্যাট ওঠাবেন। অনেকটা আনিসুল হকের ধারাবাহিক নাটক ৫১বর্তীর শেষ দৃশ্যগুলোর মতো। একই বিল্ডিংয়ে, কিন্তু আলাদা ফ্ল্যাটে। তাঁরা নিজেরা বসে চিন্তাভাবনা করে ঠিক করলেন, নিজেদের ছেলেবেলা যেখানে কেটেছে, সেখানে ফিরে যাবেন। ভাইবোন মিলে রাজশাহীতে নিজেদের পুরোনো বাড়ি ভেঙে একটা চারতলা বাড়ি বানালেন। ঢাকার খরচের চার ভাগের এক ভাগ লাগল। আজকাল উপযুক্ত ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সঙ্গে যৌথভাবে থাকতে চান না। অনেক মা-বাবাও চান ওরা নিজেদের মতো করে থাকুক। এখন যোগাযোগব্যবস্থা ভালো। ক্রমশ আরও ভালো হবে। দূরে দূরে থাকলে একে অন্যের মধ্যে টানও বাড়বে। ঢাকায় জন্মানো, বেড়ে ওঠা প্রজন্ম শেকড়ের সন্ধানে গিয়ে গ্রামকে নিজের বলে ভাববে। অনেকে বলবেন, বৃদ্ধ বয়সে ছেলেমেয়ে কাছে না থাকলে তাঁদের সেবাযত্ন করবে কে? নাতিপুতির সঙ্গও তো এক ধরনের আনন্দ। কিন্তু নগরায়ণ আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যায়ণকে অবাস্তব বলে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া কি সোজা? বরং নিজেদের গ্রামগঞ্জের আশপাশে বা আত্মীয়দের মধ্যে অনেক দরিদ্র মানুষ রয়েছেন, তাঁদের প্রতি মানবিক হাত বাড়ালে তাঁরা সেই হাত ফিরিয়ে দেবেন না। অবসরের পর যাঁরা আর বাড়তি রোজগারের জন্য ঢাকায় থাকতে চান না, ঢাকাকে আর ভারাক্রান্ত না করে তাঁরা নিজের গ্রাম-জেলা-উপজেলায় ফিরে আসুন। গুণীজন বলেন, ‘সুস্বাস্থ্য আর পুরোনো স্মৃতিই হচ্ছে সুখ।’
ঢাকায় খুপরি ফ্ল্যাটের সঙ্গে মাটির কোনো সংযোগ থাকে না। নিজের গ্রামগঞ্জে বাড়ির আঙিনায় মনের মতো বাগান করুন। দূষণমুক্ত বায়ু সেবন করুন। আপনার শিক্ষায়, আপনার অনুপ্রেরণায় ছোট করে হলেও কুসংস্কার আর সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। ছোটখাটো সমিতি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সামাজিক আন্দোলনে অবদান রাখুন। আর অপর দিকে রাজধানীও বাঁচুক, এদিকে আপনিও বাঁচুন। আপনার ছেলেবেলার চারপাশ আপনার অভিজ্ঞতা আর মেধায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.