কয়েক গুণ বেশি দামে ৪টি ফ্ল্যাট কিনছে ইসি by টিপু সুলতান

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সার্ভার স্থাপনের জন্য রাজধানীতে চারটি ফ্ল্যাট কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে মিরপুরে প্রতি বর্গফুট সাড়ে ১৩ হাজার, বাড্ডায় সাড়ে ১৮ হাজার ও তেজগাঁও এলাকায় ১৫ হাজার টাকা দরে ফ্ল্যাট কেনার চুক্তি করা হয়েছে।


সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ফ্ল্যাটের এই দাম শুধু বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশিই নয়, প্রতিষ্ঠানটির এ খাতের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়েও তা দুই থেকে তিন গুণ বেশি। প্রকল্প প্রাক্কলনে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ছয় হাজার ৭৫৬ টাকা ৭৫ পয়সা।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘কনস্ট্রাকশন অব উপজেলা অ্যান্ড রিজিওনাল সার্ভার স্টেশনস ফর ইলেক্টোরাল ডেটাবেইস’ প্রকল্পের অধীন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা সিটি করপোরেশনের অধীন ১৯টি থানা সার্ভার স্টেশন স্থাপনের জন্য ‘অফিস স্পেস’ বা ‘ফ্লোর’ ক্রয়ের প্রাক্কলিত ব্যয় হিসেবে ২৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) নিজস্ব অর্থে ঢাকায় সাতটিসহ ১৪টি ফ্লোর (গড় আয়তন ১৮৫০ বর্গফুট) কেনার জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় সোয়া কোটি টাকা।
এ-সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা যায়, ফ্ল্যাট কেনার জন্য গত বছরের ২৫ এপ্রিল দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৭ আগস্ট মূল্যায়ন কমিটি জমা পড়া দরপ্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পল্লবী ও মিরপুরের দুটি সার্ভার স্টেশন ভবনের জন্য মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে একই ভবনে দুটি ফ্ল্যাট কেনার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। পল্লবীর সার্ভার স্টেশনের জন্য এক হাজার ৭১৯ বর্গফুট ও মিরপুরের সার্ভারের জন্য এক হাজার ৯০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনার চুক্তি করা হয়। গুলশান সার্ভার স্টেশনের জন্য বাড্ডায় এক হাজার ৩৩০ বর্গফুট ও তেজগাঁও সার্ভার স্টেশনের জন্য ফার্মগেট এলাকায় এক হাজার ২৯১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনার চুক্তি করেছে কর্তৃপক্ষ।
মিরপুরের দুটি ফ্ল্যাটে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়ছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা করে যথাক্রমে মোট দুই কোটি ৩২ লাখ ছয় হাজার ৫০০ টাকা ও দুই কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর জন্য নর্দান ফাউন্ডেশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। প্রতি বর্গফুট সাড়ে ১৮ হাজার টাকা করে বাড্ডার ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে দুই কোটি ৪৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। এটি কেনা হচ্ছে আরমা রিয়েল এস্টেটের কাছ থেকে। আর প্রতি বর্গফুট ১৫ হাজার টাকা করে এস আসাদুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে এক কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে তেজগাঁওয়ের সার্ভারের জন্য একটি ফ্ল্যাট।
নির্বাচন কমিশনের এই প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে এম সালজার হোসেন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি। সাত সদস্যের মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্র প্রস্তাবে পাওয়া দর বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে রাজধানীর নামকরা একাধিক আবাসন বা ফ্ল্যাট নির্মাণ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুর ও পল্লবী এলাকায় তৈরি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি বর্গফুটে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা। বাড্ডা এলাকায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তেজগাঁও এলাকায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট ও কম পরিচিত আবাসন কোম্পানিগুলোর ফ্ল্যাটের দাম আরও কম।
নির্বাচন কমিশন দরপত্র আহ্বান ও ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে গত বছর। তখন ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য আরও কম ছিল বলে বেসরকারি আবাসন কোম্পানির সূত্রগুলো জানিয়েছে।
বাজারদরের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের চুক্তি করা এসব ফ্ল্যাটের দামের পার্থক্য এত বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক কে এম সালজার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে দরপত্র ডেকে এসব ফ্ল্যাট কিনছেন। দরপত্রে যার যা খুশি দর দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রামপুরা এলাকায় তাঁরা প্রতি বর্গফুট দরপ্রস্তাব পেয়েছেন ২৭ হাজার টাকা করে। কিন্তু ওই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনায় নেননি।
চলমান বাজারদর থেকে সার্ভার স্টেশনের জন্য কেনার চুক্তি করা ফ্ল্যাটগুলোর দাম এত বেশি হওয়ার পক্ষে কিছু যুক্তিও তুলে ধরেন সালজার হোসেন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ফ্ল্যাট কিনতে গেলে কিছু কমন স্পেস থাকে। আর কমন স্পেসের জন্য আলাদা মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আমরা দরদাতাদের বলেছি, ওই কমন স্পেসের দরও সংযুক্ত করে দিতে। আবার তারা ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করলে সব ট্যাক্স ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেয়। সেটা পড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। আর সাধারণত কর ফাঁকি দিতে রেজিস্ট্রির সময় বিক্রয়মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সঠিক দামই উল্লেখ করতে হয়। বিক্রেতারা এসব হিসাব করে এবং তার সঙ্গে আরও অন্তত ১০ শতাংশ লাভ ধরেই দরপত্র জমা দেয়। এটাই স্বাভাবিক।’
তবে প্রসিদ্ধ কয়েকটি আবাসন কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা দাম বেশি পড়ার ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালকের এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁরা জানান, বাড্ডা বা মিরপুর এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করতে ছয় লাখ টাকার মতো খরচ হয়। আর ফ্ল্যাট বিক্রির সময় ‘কমন স্পেস’-এর মূল্য কখনো আলাদা ধরা হয় না, ফ্ল্যাটের মধ্যেই ধরা হয়।

No comments

Powered by Blogger.