গোধূলির ছায়াপথে-এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু... by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

সামনে শীত আসছে। নানাবাড়ি ডোমারে চলেছি বহুদিন পর। ৩০০ ছেলেমেয়ে ভোর থেকে অপেক্ষা করছে মহিলা কলেজের সামনে। কানাডা থেকে ফি বছর বন্ধুরা আসেন ‘স্লিপিং কিটস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ [SCAW] প্রোগ্রামে শিশুদের জন্য এই সম্ভার বিতরণ করতে, যাতে জামাকাপড়, দুটি কম্বল, বালিশ, মশারি, বেডকভার, খাতা-পেনসিল, আরও কত কী নিয়ে প্রস্তুত একটি কিট।


১৫ বছর ধরে চলছে এই কার্যক্রম। ২০ কোটি টাকা মূল্যের সম্ভার বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিতরণ করতে গিয়ে বিদেশি বন্ধুরা প্রত্যক্ষ করেন তাদের মুখের অমলিন হাসি। এটুকুর জন্য তাঁরা এত দূর থেকে ছুটে আসেন। বলেছেন, দেওয়ার আনন্দের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা নেই। একেকটি ছেলেমেয়েকে কাপড় পরাচ্ছেন ও স্বর্গীয় আনন্দে হচ্ছেন বিভাসিত, দেওয়ার আনন্দ তখন সবকিছু ছাপিয়ে।
শুধু দেওয়াই নয়, সুন্দর করে দেওয়া। দর্জি ভাবছেন, কত সুন্দর করে কাপড়টি কাটব, তারপর ভাঁজে ভাঁজে সুঁইয়ের ফোঁড়ে সৃষ্টি হবে নতুন জামা। রাস্তায় কয়েকজন শ্রমিক গায়ের ঘাম ঝরিয়ে খোয়া বসাচ্ছেন, বালু-সুরকি ও পরে পিচ দিয়ে তৈরি করছেন রাস্তা, যে রাস্তায় হেঁটে যাবে দুরন্ত পথিক কোন পার থেকে কোন পারে। কবি ভাবছেন, মনের ভাবনাগুলো কত সুন্দর করে কথার বৃষ্টির নূপুর পরিয়ে পরিবেশন করব পাঠকের সামনে। একটু পরে অপারেশন হবে একজনের, ছানি অপসারণ। চার-পাঁচজন ডাক্তার-নার্স ছোটাছুটি করছেন। প্রথমে এক্স-রে, ব্লাড প্রেশার, আই প্রেশার মাপা হচ্ছে। অ্যাপ্রোন পরে ডাক্তার প্রস্তুত, বিরাট যন্ত্রটি চোখের মধ্যে স্থাপিত হলে ডাক্তার বলছেন ফিসফিস করে, খুব ভালো হচ্ছে, চিন্তার কারণ নেই। হাত-পা বাঁধা, যাতে রোগীর ছটফটে চোখের অপারেশনের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয়। সবার ভাবনা, কত সুন্দর করে কাজটি করব। কিছু দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছি। চলে যাব খানিক পরে, কী দিয়ে গেলাম, কী দিতে পেরেছি, কী দিতে পারব—এটিই চিন্তা।
কেউ ক্ষতি করেছে আমার, তারও ক্ষতি করার কথা ভাবছি বৈকি। চাকরি নিয়েছেন, নিশ্চয়ই শত্রু হবেন। ক্ষমা করে দিলে কেমন হয়। ক্ষমা করে দিয়ে হালকা হলাম। যেন হলাম অন্য মানুষ, দয়ার নদী। যিনি ব্যবসা কেড়ে নিয়েছেন, মৃত্যুপথযাত্রী। তার শিয়রে প্রভুকে বললাম, অভিযোগ প্রত্যাহার করলাম। যেন নদী থেকে সমুদ্রের দিকে ধাবমান হচ্ছি। রুজি কেড়ে নিয়ে স্থানচ্যুত করেছেন, এমন ব্যক্তিকে দেখলাম বেহেশতের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রহরীরা আটকে দিয়েছেন আমার সঙ্গে ব্যবহারটুকুর কারণে। আল্লাহকে বললাম, আমার সবকিছু কেড়ে নাও, তবু ওকে ভেতরে ঢুকতে দাও। একটি আলোকের স্তম্ভ যেন প্রবেশ করল আমার মাঝে, যখন অস্ফুট স্বরে গাইছি:
‘বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা’
বিগলিত করুণা, রহমান রহিমা\
অবারিত অশ্রুও একসময় শুকায়। হূদয়ে গাঁথা হয় করুণার গান, ক্ষমার গান। আর কোনো গান নেই সেখানে। এ আলোর দর্শন একটি কারণেই: সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি বলে। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে বললাম, হূদয়ে ক্ষমা ছাড়া আর কিছু পাচ্ছ? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, পাচ্ছি। ক্ষমা চাও প্রতি অবাধ্যতার জন্য, প্রতি অন্যায় আচরণের জন্য, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশী, নিকট দূরের। ক্ষমা চাইলেই হবে না, ক্ষমা শব্দটি কেমনভাবে লেখা হলো তোমার কলিজায়, তার ওপর নির্ভরশীল ফলাফল। ক্ষমার পরীক্ষা প্রতিদিন দিয়ে চলেছি। জিজ্ঞেস করি প্রভুকে, ক্ষমা করেছ? উত্তর নেই, অর্থাৎ ক্ষমা পাইনি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমাভিক্ষা।
ক্ষমা চাইতে না শিখলে কিছুই শেখা হয়নি। গৃহপরিচারিকারা উচ্চ স্বরে দোষারোপ করে চলেছেন। তেল নুন তরকারি নিয়ে, আধিপত্য নিয়ে শোরগোল। খবরের কাগজ এল। সেখানেও নিম্নমানের দোষারোপ। নিজে ক্ষমা করতে না শিখলে তাঁর কাছে ক্ষমা পাব না। সারা দিনমান অন্যের কাছে ক্ষমাভিক্ষা, কারণে-অকারণে।
জহির উদ্দিন শাহ্ মুহাম্মদ বাবর ফারগানা থেকে এলেন ভারতবর্ষে। কত লোকের মাথা পড়ল কাটা, কত নারী দিলেন সিঁথির সিঁদুর, ইতিহাসে লেখা নেই। কত যুদ্ধ, পৃথিবীর নানা প্রান্তজুড়ে, কে তার হিসাব রাখে। ৭০০ বছর ধরে ভারতবর্ষেই রাজত্ব করেছে মুসলমানেরা প্রেম দিয়ে, মহত্ত্ব দিয়ে, ক্ষমা দিয়ে। তাই তারা ‘মেলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে’। হিন্দুরা চাইলে মুসলমানদের ৭০০ বছরের শাসন নিয়ে আরও ৭০০ বছর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপর্ব চালাতে পারত।
দুটি মহাযুদ্ধের বিচার মিত্রপক্ষের প্রয়োজনেই। নিজেরাই যুদ্ধ করে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করে, আবার নিজেরাই কোর্ট-কাচারিতে ‘উইগ’ পরে বিচারের তামাশায় বসে। এমন বিচার করা উচিত হবে না, যা পড়ে লোকে হাসবে। যেন ‘বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে’ না কাঁদে। ইরাকের যুদ্ধে মিলিত শক্তি ডিজিটাল যুদ্ধ শুরু করে শত শত বোমারু বিমান নিয়ে। সেদিন টেলিভিশনের সামনে তসবিহ হাতে অশ্রু চোখে। সহযোগী কলামিস্ট পুরোনো কাপড় ফেলে দিয়ে পরলেন সেলাইবিহীন সাদা নতুন পোশাক। বিসর্জন দিলাম পাশ্চাত্যের পোশাকের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘টাই’। অক্ষমের প্রতিবাদ।
সংসারে কিছু ঝগড়া হয়, একসময় তা থেমে যায়। আমাদের ক্ষেত্রে দিনে দিনে বাড়ে এ আগুনের লেলিহান শিখা, বাস থেকে ট্রেনে, ট্রেন থেকে লঞ্চে। তখন গাই: ‘এক ঘরেতে লাগলে আগুন পোড়ে অনেক ঘর/ মনের আগুন মনেই পোড়ে নাই কোন দোসর।’
মনের আগুনের নিবৃত্তির জন্য খালেস তওবা। সবাইকে করতে হয়। তুলসীকেও পূজার পূর্বমুহূর্তে ধুতে হয়, ওখানেও ধুলাবালু বিস্তার। যখন ভাবছি, আমিই সত্য, অন্যেরটা মিথ্যা, তখনই ভুলের শুরু। অহংকার আল্লাহর সাজে, মানুষের নয়। অহংকার পতন আনবেই, সবচেয়ে শক্তিধর আণবিক বোমার অধিকারীই হোক, আর ঘরের পরিচারিকাই হোক। ক্ষমা চাই নিজের, পরিবারের, পাড়া-পড়শি, সবার জন্য। পর নয় কেউ, সবাই আপন। হে প্রভু, ক্ষমা কর। ব্যক্তিগত ক্ষমা চাওয়া নয়, একসঙ্গে ক্ষমা চাওয়া। ‘এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু, পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু...’।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.