খেলা-টেস্ট ক্রিকেটে ১০ বছর ও কিছু করণীয় by আখতার হোসেন খান

প্রথম আলোর ‘টেস্ট ক্রিকেটে ১০ বছর’ নামের বিশেষ সংখ্যা এক অপূর্ব ও আনন্দদায়ক পঠন। জালাল আহমেদ চৌধুরী, উৎপল শুভ্র, রাজীব হাসান, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, শিল্ড বেরি প্রমুখের তৃপ্তিদায়ক লেখা, এক জায়গায় করা অনেক প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ও বর্তমান তারকাদের মন্তব্য-মতামতভরা সংখ্যাটি সংরক্ষণ করার মতো।


গত ১০-১৫ বছরে ক্রিকেটের সামনে চলে আসার যে অনিবার্যতা আমরা দেখছি, এই প্রকাশনা তার অনন্য স্বীকৃতি।
প্রায় ২০ বছর হয়েছে ক্রিকেট গ্রামাঞ্চলেও শিকড় গেড়েছে। সরঞ্জামের প্রকট অভাব, খোলা সমান মাঠের অপর্যাপ্ততা আর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষকের পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি সত্ত্বেও খেলা চলছে। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম বা খুলনা-রাজশাহীর যেকোনো পথেই রওনা দেওয়া যাক না কেন, কিছু সময় পরপরই চোখে পড়বে ক্রিকেটের প্রাণবন্ত আয়োজন। এ আয়োজন পরিপূর্ণ নয়, কিন্তু কোথাও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের-আনন্দের কমতি নেই। গ্রামবাংলার পথেঘাটে এ দৃশ্য। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় যেমন সারা দেশ ছেয়ে যায় শক্তিধর ফুটবল দলগুলোর পতাকায়, তেমনই ক্রিকেটের এই দেশব্যাপী সমারোহ প্রমাণ করে সামষ্টিক জীবনে হাজার অভাব-অনটন-দারিদ্র্য সত্ত্বেও গ্রামবাংলা জীবনের মহত্তর আনন্দগুলো ভুলে যায়নি; যতটা সম্ভব মাথা উঁচু করে তার সন্তানেরা বাঁচতে চায়। খেলা যে বিশ্বকে এক করতে পারে, দুনিয়ার রাজনৈতিক নেতারা যা পারেননি, তার প্রমাণও এতে মেলে।
উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাক-এর সম্পাদক শিল্ড বেরির মূল কথার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন যে হয়তো বা আমাদের টেস্ট মর্যাদা একটু আগেই এসে গিয়েছিল। আইসিসির তখনকার সভাপতি জগমোহন ডালমিয়ার প্রয়াস, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন কর্তাদের যারপরনাই চেষ্টা আর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সমর্থন টেস্ট মর্যাদাকে হয়তো বা অপ্রত্যাশিত ত্বরায় সম্ভব করে তুলেছিল। সে মর্যাদা আর হারানোর ভয় নেই। কিন্তু ১০ বছরে ৬৮ টেস্ট খেলে ৫৯টি পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিন দিনের বেশি খেলতে ব্যর্থতায় সে মর্যাদায় কতখানি সম্মান যুক্ত হয়েছে, তা নিয়েও নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠতে পারে। শিল্ড বেরি সেই প্রশ্নগুলোই তুলেছেন এবং তা বাংলাদেশের ক্রিকেটের বন্ধু হিসেবেই।
এর পরও নিশ্চয়ই বাংলাদেশিদের বিচ্ছিন্ন কিছু সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার অধিকার আছে। আইসিসি ট্রফিজয়ের পর বা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষণে বিশিষ্ট সংগঠক রাইসউদ্দীন আহমেদের শিশুর মতো কান্না একটা জনগোষ্ঠীর সামবায়িক চিত্তচাঞ্চল্যেরই বহিঃপ্রকাশ। অভিষেক টেস্টে ৯ উইকেটে পরাজয় নিশ্চয়ই সুখস্মৃতির নয়। কিন্তু জালাল আহমেদ চৌধুরীর কবিতার মতো কথা বারবার আওড়াতে ইচ্ছে করে, বলতে হয়, ‘তার পরও মগজের স্মরণ-প্রকোষ্ঠে এক অনিন্দ্যকান্তি বর্ণিল পাখার প্রজাপ্রতি নিত্য ওড়ে সেই পরাভবকে ঘিরে। জয়-পরাজয়ের হিসাব ছাড়িয়ে বিশ্বক্রিকেটের কুলীন উঠোনে প্রথম পদক্ষেপ দীপ্তি ছড়ায় অগ্রসরমাণ ভবিষ্যতের শরীরে। আমাদের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ...আমাদের কাছে এসেছিল খেলার চেয়ে বড় কিছু হয়ে...’।
ওই অনুভূতি শুধু খেলাসংক্রান্ত নয়। কেননা, খেলায় তো আমরা হেরেছি। এই বর্ণিল পাখার প্রজাপতি খেলার চেয়ে বড় কিছু হয়ে গত ১০ বছর বাংলাদেশকে বেশি কিছু দিক বা না দিক, অন্তত শিল্ড বেরির কথায়ও যা আছে, বিচ্ছিন্ন কিছু সাফল্য তো এনেছে। এর আরেকটা অবদান হলো, বহির্বিশ্বে সংবাদমাধ্যমে যে বাংলাদেশের নাম আসে নানা নেতিবাচক কারণে, টেস্ট ক্রিকেট তথা ক্রিকেটের অন্যান্য ফরম্যাটে দুনিয়ার বড় দলগুলোর সঙ্গে অংশ নেওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের নাম আসে ইতিবাচক কারণে—বাংলাদেশের যুবকেরা ভালো কিছু করছে।
দেশের অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ইতিহাস গড়া শতরানের কাহিনি, যা তাঁকে নিয়ে গেছে অস্ট্রেলীয় চার্লস ব্যানারম্যান আর জিম্বাবুয়ের ডেভিড হটনের পাশে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে এবং উৎপল শুভ্রর ছবির মতো বর্ণনায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখের সামনে, ‘...ঘরে ঘরে টেলিভিশনের সামনে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁরা যেমন ফেটে পড়লেন উল্লাসে, তেমনি কানে রেডিও লাগিয়ে রাস্তায় বেরোনো পথচারী, অফিস-আদালতে “বুলবুলের কী হলো” ভেবে কাজে মন বসাতে না পারা বড় কর্তা থেকে সাধারণ কর্মচারী সবাই ওই মুহূর্তে জাগতিক সব দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে স্নাত হলেন অনির্বচনীয় এক অনুভূতিতে...।’
শিল্ড বেরির যে কথাটি আমার কাছে আলোচ্য মনে হয়েছে, তা এ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে। ছয় দলের ধারণা বাংলাদেশ হয়তো বা অস্ট্রেলিয়া থেকে নেয়নি। বিষয়টি নিতান্ত কাকতালীয়। অস্ট্রেলিয়ায় স্টেট ছয়টি। বাংলাদেশে যখন ঘরোয়া ক্রিকেট এর সর্বোচ্চ পর্যায়ের অর্থাৎ প্রথম শ্রেণীর ফরম্যাট আয়োজন করে, তখন প্রশাসনিক বিভাগ ছয়টি। এ জন্যই তাতে ছয়টি দল। আজ প্রশাসনিক বিভাগের সংখ্যা সাতে উন্নীত হয়েছে। দু-এক বছরের মধ্যেই, এরই মধ্যে আবেদন না এসে থাকলে, রংপুরও চাইবে জাতীয় লিগে খেলতে এবং ভবিষ্যতে নতুন নতুন বিভাগ হলে তখন এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট-কর্তারা এ সংখ্যা কি বাড়িয়েই চলবেন? কী ফায়দা এ ধরনের সংখ্যা বাড়িয়ে একটা আবেদনহীন প্রতিযোগিতা চালানোর? কিছুদিন আগে জাতীয় লিগের খেলায় মিরপুর স্টেডিয়ামের নিরুত্তাপ নিষ্কলুষ কংক্রিটের গ্যালারি ওই আবেদনশূন্যতার সাক্ষী।
এর সঙ্গে তুলনীয় ফুটবলের অধুনালুপ্ত শেরেবাংলা কাপের। প্রায় সব কটি জেলা দল এতে অংশ নিতে আসতে বাধ্য হতো। এক-দুই খেলার পরই তাদের খেলা শেষ। সঙ্গে উৎসাহও শেষ। কেন্দ্রীয় কর্তারা ক্ষুব্ধ হতেন অংশ না নিলে। তাঁরা কখনো হিসাব করতেন না, কত টাকা দিয়েছেন এ কাজে।
ক্রিকেটের জাতীয় লিগের বর্তমানে চালু প্রাথমিক পর্যায়ের ভেন্যু নির্বাচনও হাস্যকর। প্রতিযোগী দুই দল খেলে তৃতীয় আরেকটি বিভাগে গিয়ে। শুনেছি, একবার নাকি স্বাগতিক দলের সমর্থকরা এক খেলায় মারামারি করেছিল, আর তাতেই তেতে গিয়ে কর্তারা কোনো হোম টিম না থাকার নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত করেন। বেরি স্থানীয় খেলোয়াড় না থাকার যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় দর্শক না থাকার বিষয়টি। তিনি বলতে ভোলেননি, সিলেট দল সিলেটে খেলে না।
যদি বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে এমন হতো যে বতসোয়ানা আর গ্যাবন খেলবে গিয়ে মৌরিতানিয়ায় অথবা বাংলাদেশ আর আফগানিস্তান খেলবে মঙ্গোলিয়ায়—ব্যাপারটা ওই ধরনের একটা চিত্র। খেলার সঙ্গে সমর্থক-সম্পৃক্ততা না থাকলে খেলার কী প্রয়োজন! মস্কোয় বরফের শীতের রাতে ক্রেমলিনের দেয়ালের গা ঘেঁষা আলেকজান্ডার গার্ডেনে বসানো বিজয় দীপশিখায় প্রতি ঘণ্টায় রক্ষীবদল হয় সম্ভবত পৃথিবীর সেরা শুদ্ধতায়; কিন্তু সেখান থেকে দূরের কারও জন্য ওই কসরত কতটা মূল্যবান?
টেস্ট খেলার মানসিকতা সৃষ্টির জন্য লম্বা ইনিংসের প্রতিযোগিতা অপরিহার্য। কিন্তু ছয়টি দলের সর্বোচ্চ পাঁচটি করে খেলা, বিশেষ করে যাতে নিজস্ব সমর্থক নেই এবং তা আবার বিস্ময়করভাবে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে। এটা কীভাবে টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট বা শেফিল্ড শিল্ডের মানস গড়তে সাহায্য জোগাবে, তা মাথায় ঢোকে না।
সমস্যা শুধু এখানেই নয়, ভারতের নেতৃত্বে বিশ্বক্রিকেটে সাম্প্রতিক কালের অর্থযোগের যে বিপ্লব, তা বিশ্বক্রিকেটের জন্য সমূহ সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়ার পরও টি-টোয়েন্টি নামের কুহকে মজে গেলে টেস্ট মানসিকতার কী হবে, তা এক বড় প্রশ্ন হিসেবে অব্যাহতই থাকবে। অস্ট্রেলিয়ায় শেফিল্ড শিল্ড এখনো হয়তো বা সে দেশে আকর্ষণ হারায়নি, কিন্তু ইংল্যান্ডে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর প্রতিযোগিতাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে শিল্ড বেরি যে প্রশাসনিক সংস্কারের কথা বলেছেন, তা জরুরি বিবেচনার দাবি রাখে। ক্রিকেট বোর্ডে পূর্ণকালীন কিছু কর্মকর্তাই যথেষ্ট নয়, যদিও বা প্রয়োজনীয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি অব্যাহত থাকবে আরও বহুদিন; কিন্তু দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে জাতীয় প্রথম শ্রেণীর লিগকে অবিলম্বে সম্প্রসারণ করে তাকে হয় পরিপূর্ণভাবে অঞ্চল, নতুবা ক্লাবভিত্তিক করতে হবে। আঞ্চলিক হলে অবশ্যই সে অঞ্চলের খেলোয়াড়দের স্থানীয় দলে খেলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ক্লাবভিত্তিক হলে হয়তো বা তা বর্তমান যুগের জন্য বেশি উপযোগী হবে। বাংলাদেশ বড় দেশ নয়; ভারতের মহারাষ্ট্র-পাঞ্জাব বা অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া-কুইন্সল্যান্ড যে দ্যোতনা আনে, বাংলাদেশে ঢাকা-বরিশাল বা চট্টগ্রাম-সিলেট সে ধরনের বার্তা দেয় না।
বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল কাঠামোরূপে রাষ্ট্রের ‘ইউনিটারি’ চারিত্র স্বীকৃতি থাকায় প্রদেশ গড়া দুষ্কর। আর প্রদেশ হোক বা বিভাগই হোক, জনগোষ্ঠীর অভিন্নতা থাকায় তা সমর্থক-গোষ্ঠী তৈরিতে তেমন পারঙ্গম নয়।
হোম আর অ্যাওয়ে ফরম্যাট লম্বা লিগের জন্য অপরিহার্য। খেলোয়াড়দের সব ধরনের পরিস্থিতিতে খেলার উপযোগী করার জন্যই এর উদ্ভব; এটিকে সংক্ষিপ্ত করলে লিগের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। যদি কোনো দল সফরকারী দলের নিরাপত্তাবিধানে ব্যর্থ হয়, তাকে নানাভাবে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আর সে সাজার শক্ত প্রতিপালনের মধ্য দিয়েই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এ জন্য চিরদিন চলে আসা লিগের মূল ফরম্যাটে হাত দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।
বাংলাদেশের যে কিশোর-যুবকেরা গ্রামে-গঞ্জে বাঁশের কঞ্চি বা পাটখড়ির স্টাম্প, টেনিস বা ন্যাকড়ার তৈরি বল বা মাঁদারগাছের তক্তার ব্যাটে খেলে ক্রিকেটের প্রতি তাদের প্রেম প্রমাণ করে চলেছে দিনের পর দিন; অথবা আমার সেই অগ্রজপ্রতিম সুহূদ অধ্যাপক নুরুল আনোয়ার, যিনি বলেন, তিনটি জিনিস যথা—ক্রিকেট, রবীন্দ্রসংগীত আর পাটশাক ছাড়া মনুষ্যজীবন অর্থহীন। তাদের প্রতি প্রশাসকদের দায়িত্ব পূরণের সময় এটাই।
দীর্ঘদিন এই সময় পাওয়া যাবে না এবং সময়মতো এর প্রতিপালনেই নির্ভর করবে টেস্ট মর্যাদার ১০ বছরের মাথায় না হোক, শিগগিরই কোনো একসময় বাংলাদেশ নিশ্চেষ্ট পাঁচ দিনের টেস্ট খেলতে পারবে, হার-জিত যা-ই হোক না কেন। আর তখন হয়তো উইজডেন-এর সম্পাদক প্রথম আলোর ভবিষ্যৎ কোনো বিশেষ সংখ্যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কর্ণকুহরে আরও সুখপ্রদ লাগে, এমন লেখা লিখবেন।
আখতার হোসেন খান: সাবেক সচিব, ক্রীড়াবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.