দূর দেশ-২০১৩ সাল অনেক দূরে নয় by আলী রীয়াজ

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ও প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কের যে দ্রুত অবনতি ঘটেছে এবং দেশের রাজনীতি যে অস্থিতিশীলতা অভিমুখী হয়ে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


চার বছর ধরে বিএনপি যে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে এবং কোণঠাসা অবস্থায় থেকেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দলটি এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনো রাজনৈতিক দল যখন দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, তখন এক ধরনের বেপরোয়া ভাব লক্ষ করা যায়। সেই অর্থে বিএনপি খুব বেশি সময় এ অবস্থায় আছে তা নয়। অতীতে বিএনপি এর চেয়েও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থেকেছে এবং সংকট মোকাবিলা করেছে। কিন্তু তখন বিএনপির নেতাদের মধ্যে এতটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ করা যায়নি। ক্ষমতার বাইরে থাকলে সাধারণত যতটা অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলা করতে হয়, অন্ততপক্ষে অতীতে যতটা করতে হয়েছে, বিএনপির গত চার বছর সে তুলনায় অনেক কম সংকটময়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি তার প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি সমস্যা মোকাবিলা করেছে। তার কারণ পূর্ববর্তী পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে তাদের কর্মকাণ্ড। বিএনপির নেতারা সম্ভবত আশা করেছিলেন যে নির্বাচনে তাঁরা সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতি লাভ করবেন। অতীতে বিএনপি সংকটময় পরিস্থিতির শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৮২ থেকে ’৯০ সালের পর দলটি ’৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের সেই আশা তো পূর্ণই হয়নি, বরং তারা এযাবৎকালের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করে। তদুপরি বিএনপির নেতাদের মধ্যে সম্ভবত এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবার বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে। তাঁদের ছাড়া বিএনপি ভবিষ্যতে আর সংগঠিত হতে পারবে না।
বিএনপির মরিয়া হয়ে ওঠার লক্ষণ যখন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, সে সময় দলের নেতাদের হাতে সরকার একটি উপলক্ষ তুলে দিয়েছে নভেম্বর মাসে। সেনানিবাসের যে বাড়িতে খালেদা জিয়া বসবাস করতেন, তা থেকে তাঁকে ‘উচ্ছেদ’ করার ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপগুলো সুবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হয় না। আইনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড যথাযথ পদক্ষেপ নিলেও তার রাজনৈতিক ফল বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, বোঝাই যায়। অন্যপক্ষে খালেদা জিয়া বাড়ি দখলে রাখার জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, তা রাজনৈতিক নেতা, বিশেষত সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এবং তাঁর দলের জন্য ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকারক। এর জন্য তাঁর পরামর্শদাতারা দায়ী, না তিনি কৌশলগত ভুলের শিকার হয়েছেন, তা নিয়ে বিএনপিতেই বিতর্ক রয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া ও দলের কর্মসূচি উভয়ই আত্মঘাতী হয়েছে। কিন্তু এসবই হচ্ছে বিএনপির মরিয়া হয়ে যেকোনোভাবে রাজনৈতিক স্রোতকে অনুকূলে আনার চেষ্টা।
সেই ধারা অনুসরণ করেই বিএনপি আরেক দফা হরতাল ডেকেছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, বিএনপি জাতীয় সংসদে আর ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং দলের সাংসদেরা পদত্যাগ করতে উদ্যোগী হচ্ছেন। জাতীয় সংসদকে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দেশ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু করা হবে বলে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই ব্যর্থ হয়েছে। এখন বিএনপির সদস্যরা পদত্যাগ করলে সংসদ নিয়ে জনসাধারণের উৎসাহ আরও কমবে। বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন, এতে সংসদ তার বৈধতা ও কার্যকারিতা হারাবে। আর এর ফল বিএনপি তার ঘরে তুলতে পারবে। কিন্তু বিএনপির নেতারা সম্ভবত বিস্মৃত হচ্ছেন যে এখনো তিন বছর এই সংসদের মেয়াদ রয়েছে। তদুপরি এই তিন বছরে দলগতভাবে তাঁদের পক্ষে রাজপথে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। এ বছরের জুন ও নভেম্বর মাসে বিএনপির দেওয়া হরতাল ‘সফল’ হলেও সাধারণ মানুষ তা সমর্থন করেনি। উপরন্তু খালেদা জিয়া ও বিএনপি হরতাল ডাকার আগে যতটা সহানুভূতি লাভ করেছিল, এক দিনে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি সহানুভূতি হারিয়েছে।
বিএনপির নেতারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আগে এসব বিবেচনা করবেন, এমনটা আশা করলেও বাস্তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যদিকে সরকার নিশ্চয়ই লক্ষ করছে যে বিএনপিকে অনুসরণ করে অন্যান্য দলও রাজপথে নামার চেষ্টা করছে। বিএনপি যদিও দাবি করছে যে তাদের ডাকা হরতালের সঙ্গে খালেদা জিয়ার উচ্ছেদের কোনো সম্পর্ক নেই, এ কথা দলের কর্মীরাও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। সেটি প্রমাণ করতে চাইলে বিএনপি আরও কিছু সময় অপেক্ষা করত। অন্য যাঁরা পথে নামার চেষ্টা করছেন, তাঁদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাঁরা একে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতেই উৎসাহী।
অস্থিতিশীলতা অভিমুখী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণ বা উপলক্ষ যা-ই হোক না কেন, এরই মধ্যে কিছু লক্ষণ পরিষ্কার হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এই টানাপোড়েনে প্রধান বিচারপতি ও সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। অন্য অনেক বিশ্লেষকের মতো আমিও মনে করি, ক্যান্টনমেন্টের একটি বাড়ির বিষয়ে আদালতের একটি রায় বাস্তবায়নে আইএসপিআরকে যেভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। এ বিষয়ে সরকারকে যাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁদের এই সিদ্ধান্তের জন্য ক্ষতির দায়ভার বহন করা উচিত। আদালতের রায় থেকে এটাও স্পষ্ট যে সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তিগত ইচ্ছায় যে বা যাঁরা দান করেছিলেন, তাঁরা আইন ভঙ্গ করেছেন। এ কথা সবাই জানেন যে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। এ ধরনের বেআইনি কার্যকলাপের কারণে তাঁকে কেন কোনো দায় নিতে হবে না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিতর্কে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা দুই পক্ষের হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন এবং সংবাদ সম্মেলন করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরা বেসামরিক ব্যক্তি এবং তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের বক্তব্য পেশ করতে পারেন। কিন্তু দুই পক্ষই একটি বিষয়ে মতামত দিয়েছে যে সেনাবাহিনীকে এ ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা ঠিক নয়। তাঁরা সমষ্টিগতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ কাজে শরিক হয়ে পড়লেন কি না, আশা করি, সাবেক সেনা কর্মকর্তারা তা ভেবে দেখবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রায়ই যেখানে প্রশ্ন ওঠে, বিডিআরের তথাকথিত বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার বিচার যখন সম্পন্ন হয়নি এবং সেনাবাহিনীতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য উসকানি দেওয়ার লোকের যখন অভাব নেই, সে সময় এসব পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সব মহলেরই উচিত ধৈর্য ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেওয়া।
বিএনপির সমর্থক কয়েকজন আইনজীবীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতির প্রসঙ্গও বিতর্কে এসেছে। প্রধান বিচারপতির উচিত হবে কোনো এক সুযোগে এ নিয়ে রহস্যের সমাধান করা। প্রতিষ্ঠান হিসেবে উচ্চ আদালত ও প্রধান বিচারপতি বিতর্কিত হয়ে পড়লে তার পরিণতি ভালো হয় না। এ প্রসঙ্গে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে।
২০০৬ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। অক্টোবরে ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে যাওয়ার আগেই আসন্ন নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি প্রতিষ্ঠান—নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি—বিতর্কিত হয়ে উঠতে থাকে। এ প্রক্রিয়াটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যে কতটা কঠিন ছিল, বাংলাদেশের মানুষ তা ভুলে যায়নি, রাজনৈতিক নেতাদের তা ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয়, তাঁরা মনে করছেন, ২০১৩ সাল অনেক দূরে।
ইলিনয়, ২৫ নভেম্বর, ২০১০
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.