এমপির পরিবারই সব

ল বা দলের নেতৃত্ব নয়, মেহেরপুরে সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক সংসদ সদস্যের ছেলে, ভাগ্নে, জামাই, শ্যালক, স্ত্রী এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন। টেন্ডার, হাটবাজার, মাঠ-ঘাট-বিল দখল, অফিস-থানা-আদালতে প্রভাব, প্রকল্প বরাদ্দ, চাকরিতে নিয়োগ-বদলি এবং কেউ অবাধ্য হলে তার শাস্তি নির্ধারণ_সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর স্বজনরা। ফলে খুব অল্প সময়েই তাঁদের বিত্ত-বৈভব এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রভাবের কাছে দলীয় নেতা-কর্মীরা একবারেই তুচ্ছ হয়ে গেছেন।


এখন ক্ষমতা ও সুবিধার সবকিছুই তাঁদের হাতের মুঠোয়। এ নিয়ে সংসদ সদস্যের সঙ্গে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের বিরোধ এখন তুঙ্গে। দলের একাধিক বর্ধিত সভায় নেতারা সংসদ সদস্যের নগ্ন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু সংসদ সদস্যের ক্ষমতার কাছে নেতাদের এই প্রয়াস কোনো কাজে আসেনি। সরেজমিনে দলের অধিকাংশ নেতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের অনেক ত্যাগী কর্মীর সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা সংসদ সদস্যের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে দলের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে হতাশা প্রকাশ করেন। এই প্রশ্নে খোদ দলীয় নেতাদের ভাষ্য, বর্তমান সংসদ সদস্যের দুর্নীতি মেহেরপুরের সব আমলের দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে এমপির সঙ্গে নেতাদের সম্পর্কের শুধু অবনতিই ঘটেনি, দলে চরম বিভক্তি এবং প্রকাশ্য দ্বন্দ্বও দেখা দিয়েছে, যা বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে মঙ্গলের সুবাতাস বয়ে এনেছে। কেননা, সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে দলের বড় একটি অংশকে বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে এখন দলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করতে হচ্ছে। মেহেরপুরে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় কী করছেন_জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এবং স্থানীয় সাধারণ বাসিন্দারা জানান, সংসদ সদস্যের ধর্মশ্যালক আক্কাস আলী, ছেলে তানভীর আহমেদ রানা, জামাই ফজলে রাব্বানী বাবু, ভাগ্নে রিপন আর রিটন এবং শ্যালক ইসলাম আলীই সবকিছু জানেন। তাঁরাই এখন এলাকার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। এখানে দলীয় নেতারা তাঁদের কাছে এখন গুরুত্বহীন। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন, সংসদ সদস্যের ধর্মশ্যালক হিসেবে পরিচিত আক্কাস আলী ফ্যাসিলিটিজ, গণপূর্ত এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বে। ভাগ্নে মাহফুজুর রহমান রিটন রেজিস্ট্রি অফিস, শ্যালক ইসলাম আলী টিআর ও জিআর এবং শ্যালক তরিকুল ইসলাম দেখেন থানা ও হাসপাতাল। আর সংসদ সদস্যের ছেলে রানা এবং জামাই গাংনী ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ফজলে রাব্বানী বাবু চাকরি ও নিয়োগ সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করেন। বাবু আগে বিএনপি করতেন। শ্বশুরের বদৌলতে এখন আওয়ামী লীগ করেন। সংসদ সদস্যের শ্বশুর খোদাদাদ হোসেন ভিকু মিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজাকারের ভূমিকায় ছিলেন। 'মেহেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য' গ্রন্থে রাজাকারের তালিকায় তাঁর নাম আছে। বর্তমান সংসদ সদস্য তাঁর রাজাকার শ্বশুরের নামে সাইনবোর্ডসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে সেই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বরাদ্দের অর্থ মজুদ করছেন। শ্বশুরের সুবাদে মেহেরপুরের অনেক রাজাকার এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় নেতা বনে গেছেন। সংসদ সদস্যের স্বজনদের এসব তৎপরতার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি মিয়াজান আলী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কানেও এসব বিষয় দেওয়া হয়েছে। আমরা দলীয় সভা করার কথা চিন্তা করছি।' তিনি আরো অভিযোগ করেন, জেলার কোনো কমিটিতে দলীয় নেতা-কর্মী নেই, সবখানেই ইসলাম, আক্কাস আর রিপন। এ ক্ষেত্রে দলের দুই সহসভাপতি আবদুল মান্নান মাস্টার এবং আসকার আলী সংসদ সদস্যের সহায়ক ভূমিকায় আছেন। রেজিস্ট্রি অফিসকেও তিনি তাঁর ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান জানান, জয়নালের এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং আত্মীয়করণ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তাঁর বিরুদ্ধে তিনি আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সামনে। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি মেহেরপুরে রেলপথ নির্মাণ এবং মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজ সরকারিকরণ বাস্তবায়নেও কোনো ভূমিকা পালন করেন না। মেহেরপুর পৌরসভার মেয়র মোতাছিম বিল্ল্লাহ মতু কালের কণ্ঠকে জানান, এমপি তাঁর রাজনীতিকে পরিবারতান্ত্রিক করায় জনমনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.