রংপুর বিভাগের যোগাযোগ-এখনও হাঁকাও চিলমারীর যুগে by তুহিন ওয়াদুদ

রংপুর শহর থেকে রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম যাতায়াতের অবস্থা খুবই করুণ। সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যর্থতার অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে তিস্তা সড়ক সেতু। দশ বছর ধরে তিস্তার ওপরের একটি সেতুর কাজ শেষ হতে উদ্যোগের পর উদ্যোগ নেওয়ার কাজ চলছেই। যোগাযোগমন্ত্রী স্বয়ং সেই সেতুটি গত জুনের মধ্যে শেষ না হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। এখন ডিসেম্বর মাস চলছে, কিন্তু


তিস্তা সড়ক সেতুর কাজ তথৈবচ। এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই সেতুটি না হওয়ার সঙ্গে এখানকার মানুষের শুধু ভোগান্তি তৈরি হয়েছে তাই নয়, এখানকার মানুষ সরকারের কর্মতৎপরতার ওপরও আস্থা হারিয়েছে


রংপুর বিভাগ হওয়ার পর থেকে এখানকার মানুষ ভেবেছিল বিভাগীয় শহর হিসেবে উন্নয়নের একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে রংপুরের সঙ্গে। কিন্তু সেই আশা অনেকখানি স্বপ্নের মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে। বিভাগীয় শহরের সড়ক ব্যবস্থাপনা জেলা শহরের চেয়ে ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক। সেই মর্মে কাজের উদ্যোগ চোখে পড়লেও তার যে শম্বুকগতি তাতে করে কত বছর লাগবে রংপুর বিভাগের সড়ক উন্নয়নের কাজ শেষ হতে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
রংপুর বাংলাদেশের সর্বশেষ বিভাগ। স্বীকৃতির প্রায় দু\'বছর হতে চলেছে। ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি রংপুরকে বিভাগ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই দুই বছরে বিভাগের উলেল্গখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। বিভাগ ঘোষণার পর রংপুরের সড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শুরু হওয়ার পরই সে কাজ আবার বন্ধ হয়ে রয়েছে। শহরের সড়ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দু\'ধারের প্রাচীন বৃক্ষগুলো কাটা হয়েছে। প্রায় নয় মাস হতে চলল রাস্তার দু\'ধারে অনেকখানি করে অংশ মাটি কেটে এমন করে রাখা হয়েছে যে, পাকা রাস্তা ঘেঁষে অনেকখানি নিচু করে রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে। ফলে প্রতিদিন কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। রাস্তার এই অবস্থা থাকলে যে কোনো সময়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আরও কতদিন এ অবস্থা থাকবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কাজ অসম্পূর্ণ রাখার কারণে এ বছর রাস্তার দু\'ধারে বৃক্ষ লাগানো সম্ভব হয়নি। এতে করে রংপুর শহরকে ঘিরে যে ছায়াময় সড়কগুলো ছিল তা অকারণে এক বছর আগেই কাটা হলো। রংপুর থেকে বিভাগের অন্য সাতটি জেলায় রেল এবং সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। রেল যোগাযোগের অবস্থা আশানুরূপ না হওয়ার কারণে যাত্রীদের সড়কপথের ওপর ভরসা করতে হয়। রংপুর ছোট্ট একটি শহর। এই শহরের বাসস্ট্যান্ডের সংখ্যা রয়েছে মোট পাঁচটি। কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড একটি, ঢাকার গাড়ির জন্য একটি, লালমনিহাট-পাটগ্রামের জন্য একটি, কুড়িগ্রাম-লালমনিহাটের জন্য একটি, রংপুরের গঙ্গাচরা এবং কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার জন্য একটি। ছোট্ট একটি শহরে এতগুলো বাসস্ট্যান্ড কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। শহরে প্রধান রাস্তার ওপর শাপলা থেকে জাহাজ কোম্পানি যাওয়ার পথে অনেকগুলো ট্রাক, পিকআপ ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে। শহরের ব্যস্ততম জায়গা জাহাজ কোম্পানির মোড়ে একমুখী রাস্তার ব্যবস্থা থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের সামনেই নিয়ম লঙ্ঘন করে একমুখী রাস্তার ওপর দিয়ে দু\'দিকেই গাড়ি চলাচল করছে।
সারাদেশের মতো রংপুর শহরেও প্রচুর ব্যাটারিচালিত বাইক নেমেছে। এই বাইকগুলো যেহেতু চার্জ করা ব্যাটারি দ্বারা চলে, সেহেতু তারা রাতে এই বাইকগুলো কেউ টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে, কেউ আলাদা টর্চ জ্বালিয়ে, কেউবা আলো না জ্বালিয়ে এই গাড়িগুলো চালায়। অনেক বাইকের কোনো লুকিং গল্গাসও নেই। অত্যন্ত অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণ অটোবাইক অনুমোদন পেয়েছে। এর অধিকাংশ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বলা যায়, সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলছে এই যানবাহনগুলো। তার ওপর সড়কগুলোর বেহাল দশা তো আছেই।
রংপুর শহরের ওপর দিয়ে চলে গেছে রেলপথ। এর মধ্যে দিনে প্রায় ১২-১৪ বার করে রেল যাতায়াত করে। ফলে দিনে ১২-১৪ বার করে সৃষ্টি হয় যানজটের। রংপুর বিভাগ হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে এখানে মানুষের চাপ। সে সঙ্গে যদি রংপুরকে শুরু থেকে যানজটমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে বিকেন্দ্রীকরণের কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে না। এর জন্য রংপুরের যে তিনটি অংশ দিয়ে রেলপথ রয়েছে সেখানে ফ্লাইওভার তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারমাইকেল কলেজের মতো দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ ঢাকা যাতায়াতের পথ লালবাগের যানজন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। রংপুরে বেশ কয়েকটি ওভারব্রিজের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যে স্থানগুলোতে রাস্তা পারাপার অধিক হয় এ রকম সর্বত্রই এই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হাইওয়ে থাকার কারণে এখানকার ফুট ওভারব্রিজের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরির মধ্যে জরুরি হয়ে পড়েছে।
রংপুর শহর থেকে রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম যাতায়াতের অবস্থা খুবই করুণ। সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যর্থতার অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে তিস্তা সড়ক সেতু। দশ বছর ধরে তিস্তার ওপরের একটি সেতুর কাজ শেষ হতে উদ্যোগের পর উদ্যোগ নেওয়ার কাজ চলছেই। যোগাযোগমন্ত্রী স্বয়ং সেই সেতুটি গত জুনের মধ্যে শেষ না হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। এখন ডিসেম্বর মাস চলছে, কিন্তু তিস্তা সড়ক সেতুর কাজ তথৈবচ। এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই সেতুটি না হওয়ার সঙ্গে এখানকার মানুষের শুধু ভোগান্তি তৈরি হয়েছে তাই নয়, এখানকার মানুষ সরকারের কর্মতৎপরতার ওপরও আস্থা হারিয়েছে। যোগাযোগমন্ত্রী পরিদর্শন করে নির্দেশ দেওয়ার পরও সেতুটির কাজ হয়নি। সরকারের কাছে রংপুরবাসীর গুরুত্ব যে অনেক কম তা তো বোঝাই যায়। রংপুর এক্সপ্রেস নামে একটি নতুন ট্রেন দেওয়ার কথা ছিল, সেখানে পুরনো একটি ট্রেন দেওয়া হয়েছে। সেই ট্রেনটির অবস্থা শুরুতেই এমন অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলছে যে এখন মনে হয় এ রকম একটি ট্রেনের জন্য রংপুরবাসী কি অপেক্ষা করেছিল আর এত বেহাল দশার একটি ট্রেন যোগাযোগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেরই-বা কী প্রয়োজন ছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যে ট্রেনটি চালু হচ্ছে সেই ট্রেনের সুনাম-বদনামের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সুনাম-বদনাম যুক্ত থাকতে পারে, সে চিন্তা থেকে হলেও রংপুর এক্সপ্রেসের সেবা উন্নত হওয়া প্রয়োজন ছিল।
দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে কথা উঠেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী যোগদান করেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অপবাদের গল্গানি থেকে বের হয়ে আসার অক্লান্ত চেষ্টা চলছে। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী এবং নতুন জেলা পরিষদ প্রশাসক উভয়ের উদ্যোগে রংপুর বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সাধিত হবে এই আশায় আমাদের বসতি। আমরা অপেক্ষাতেই থাকলাম।

ড. তুহিন ওয়াদুদ :শিক্ষক
বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.