চারদিক-গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী


মারামারি ছাড়াই শুধু হুংকার দিতেন। তাতেই ছাত্র-শিক্ষক সবাই ভয় পেতেন। স্কুল পালানোর সময় এদিক-ওদিক দেখে নিশ্চিত হতো, ‘টাইগার কই?’ ভাবছেন, বাঘের কথা বলছি। হ্যাঁ, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা জানেন ‘টাইগার’। বনের বাঘের চেয়েও যাঁকে বেশি ভয়পেত ছাত্ররা। স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ জহিরুল হক। ‘টাইগার স্যার’ নামে খ্যাত। স্কুলের প্রতিষ্ঠা থেকে শিক্ষকতা করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে


অবসর নেন ওই স্কুল থেকেই। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাঠে ফুটবল খেলা অথবা ঢাকা কলেজের পুকুরে নেমে গোসল করা; টিফিনের সময় নিউমার্কেট, নীলক্ষেতে ঘোরাঘুরি করা কিংবা হোজা মাল হো দেওয়া, মামার ঝালমুড়ি খাওয়া, চটপটি খাওয়া—সেই মজার দিনগুলোর কথা কখনো ভুলব না। ভুলব না আ. জা. সির, আব্দুর রশীদ, রাশেদ আলী খন্দকার, রাজ্জাকুল হায়দার, কাজী মোজ্জাম্মেল হক, মো. মোহসিন খান, আনোয়ারুল করিম, শহীদুর রহমান, আনিস সিদ্দিকী, আবুল খায়েরের মতো প্রিয় শিক্ষকের কথাও।
নুরুল কবির কণা ’৬৮ ব্যাচের বড় ভাই বলেছিলেন, ‘একবার বাসেত স্যারকে ক্লাসের সবাই বলেছিলাম, বলাকায় গিয়ে ওমুক সিনেমা দেখব। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্যার বলেছিলেন, “যাও, দেখতে পারো। ঘুরে এসে সারসংক্ষেপ লিখে দেবে।” এর ফলাফল হলো, কেউ আর সিনেমা দেখতে যায়নি।’
খান মুহম্মদ সালেক স্যারের প্রসঙ্গে ’৭৩ ব্যাচের বড় ভাই এম এ মোমেন লিখেছিলেন, ক্লাস-টিফিনের আগে ও পরে ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে একতলা থেকে দোতলা, গোটা স্কুল সালেক স্যার একবার ঘুরে আসতেন। এটা ছিল আমাদের (ছাত্র-শিক্ষক) বিদ্যুতায়িত হওয়ার সময়। বেলা তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে স্যার আবার টহল দিতেন।’
নিজের কথা বলতে পারি, কোথাও স্বনামে লেখা ছাপা হলে জহিরুল ইসলাম খান স্যার ফোন করে কথা বলেন; খোঁজ নেন তাঁর ছাত্রদের। এই সুযোগে প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করি সব শিক্ষককে।
ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ আরমানিটোলা এলাকা থেকে ধানমন্ডি এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার সময় প্রশিক্ষণরত শিক্ষকদের সুবিধার্থে কলেজ-সংলগ্ন একটি বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ল্যাবরেটরি স্কুল নামকরণ সে উদ্দেশ্যেরই প্রকাশবহ। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুহম্মদ ওসমান গণি এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক খান মুহম্মদ সালেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের ক্লাস শুরু হয়। শুরু থেকে টিফিন দেওয়া হতো শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, জিলাপি, পরোটা-ডাল, পরোটা-বুন্দিয়া, কেক, কলা ইত্যাদি।
‘নুরুন আলা নুর’ পবিত্রকোরআনের এই অমর বাণী বিদ্যালয়ের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাংলা তরজমা ‘আলো আরও আলো’ স্কুলের মনোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রকর জয়নুল আবেদিন এই অসাধারণ মনোগ্রামটির পরিকল্পনা করে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের তিনজন ছাত্র শহীদ হন। তাঁরা হলেন শহীদ আকরাম, শহীদ মুনির এবং শহীদ মাজহার।
স্কুলের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষা, ১৯৬৪ সালে প্রথমবারই বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান করে নেয়। আর পেছনে তাকাতে হয়নি স্কুলটিকে। এরপর প্রতিবছরই এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় একাধিক স্থান অধিকার করে আসছিল। ১৯৯৩ সালে এ বিদ্যালয়ের ফল ছিল খুবই গৌরবোজ্জ্বল। মেধা তালিকায় ২০টি স্থানের মধ্যে ১৭টিই দখল করে নেয়। কেবল এগিয়েছে ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে এ বছর। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে এ বিদ্যালয়টি শুধু দেশেই নয়, পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষার গৌরবদীপ্ত আলো পৌঁছে দিচ্ছে।
২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ওল্ড ল্যাবরেটরিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন (ওলসা) আয়োজন করবে পুনর্মিলন-২০১১।
‘তোমার সেই কথায় দাঁড়াই উঠে/শিখিয়েছিলে যা আমাদের/আলো আরও আলো আজ আমরাই ছড়াব...’ গত বছর সুবর্ণজয়ন্তী মহড়া অনুষ্ঠানে এই মিউজিক ভিডিও দেখানো হলে সবার চোখ ছলছল করে।
পুনর্মিলনীতে দীর্ঘদিন পর সহপাঠীর দেখা মিলবে। বুকে জড়িয়ে ধরে কেউ বলে উঠবেন, ‘কেমন আছিস, বন্ধু?’ বন্ধুদের সঙ্গে তাঁদের প্রিয় শ্রেণীকক্ষে পুরোনো স্মৃতি খুঁজতে, কাজের ব্যস্ততায় দেখা করতে পারেন না অনেকেই। পাস করার পর সহপাঠীরা কে, কোথায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সে খবরও রাখা হয় না। কিন্তু ওলসার পুনর্মিলনীতে সেই পুরোনো দিনগুলোই যেন আবার নতুন হয়ে ধরা দেবে পুরোনো শিক্ষার্থীদের কাছে। স্কুলের ধরাবাঁধা ক্লাস, পরীক্ষা আর কঠিন রুটিনের ফাঁকে আড্ডার দিনগুলোর কথা। কিশোর বয়সের সেই বাঁধভাঙা দিনগুলোর কথা আর গল্পে মেতে উঠবেন।
আগেই পড়েছেন, ২০১১ সালে বিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্ণ করে। এরই মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের উদ্যোগে তা উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ওল্ড ল্যাবরেটরিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন ২৩-২৪ ডিসেম্বর সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে।
তবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ বছরের পথচলায় যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখান থেকে বেরিয়েছে, তাঁদের পদভারে তাঁদেরই প্রিয় স্কুলের আঙিনা ভরে উঠবে—এমন আশা ৫০ বর্ষ উদ্যাপন কমিটির। দুই দিনের অনুষ্ঠানসূচি ওলসার ওয়েবসাইটে (www.laboratorians.net) জানা যাবে বিস্তারিত।
ফেরদৌস ফয়সাল

No comments

Powered by Blogger.