আওয়ামী লীগ : মেহেরপুর-১ সদর ও মুজিবনগর-দল নয়, পকেট চিন্তায় মশগুল এমপি by তানিয়া লাবণ্য

কেউ জমি বিক্রি করবেন বা কিনবেন, অথচ মেহেরপুর-১ আসনের সাংসদ জয়নাল আবেদীনের লোকজনকে টাকা দেবেন না_মেহেরপুরে সেটা হতে পারে না। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে স্ট্যাম্প ও ফি বাবদ সরকারের খাতে দিতে হয় ৯ শতাংশ। কিন্তু মেহেরপুরে এই আইন অচল। এখানে চলছে সাংসদ প্রণীত আইন। এই আইন আগে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাংসদের ভাগ্নে হিসেবে পরিচিত রিপন। গত ২ এপ্রিল রিপন খুন হওয়ার পর এখন রেজিস্ট্রি অফিস নিয়ন্ত্রণ করছেন


রিপনের ছোট ভাই রিটন। তাঁর আইন হচ্ছে এখানে কেউ জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে খরচ বাবদ শতকরা ১৬ টাকা দিতে হবে। এ থেকে সরকারের ফি আর স্ট্যাম্প খরচ বাদ দিয়ে যা বাঁচবে তা রিটন গ্রুপের। রিটন গ্রুপের সাত-আটজন সর্বদা নজর রাখে মুহুরি আর ক্রেতা-বিক্রেতাদের ওপর, যাতে কোনোভাবেই এই আইনের ব্যতিক্রম না হয়। আর মুহুরিরাও সব রিটন গ্রুপের বেতনভুক্ত। তাঁদের প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন দেন রিটন। ফলে এই অনিয়মই এখানে আইন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই আইন চালু হয়েছে। তবে মেহেরপুর রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার আবদুস সাত্তার এই অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি নিয়ম মোতাবেক এখানে ৯ শতাংশ হারে টাকা (স্ট্যাম্পসহ) নেওয়া হয়। এর বাইরে কেউ যদি টাকা নিয়ে থাকে, তবে সেটা তাদের বা ওই চক্রের নিজস্ব ব্যাপার। এই ঘটনার সঙ্গে তিনি বা তাঁর কার্যালয়ের কেউই কোনোভাবে সম্পৃক্ত নন। অথচ দল কিংবা জেলার কোনো উন্নয়নের দিকে লক্ষ নেই বর্তমান সাংসদের। দলীয় কোনো কার্যালয় পর্যন্ত নেই। সর্বশেষ দলীয় মিটিং কত তারিখে হয়েছে, তা বলতে পারেননি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক নেতা। দলের অনেক নেতা-কর্মীর অভিযোগ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপি জয়নাল আবেদীন টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, গাছ কাটা, ভূমি দখল নিয়ে ব্যস্ত আছেন। দলের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। জেলার সব কিছুকে দলীয় নয়, পরিবারতান্ত্রিক করছেন বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।
বাগোয়ান গ্রামের সার ব্যবসায়ী মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন বলেন, তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তিনি শুনেছেন, তাঁদের সাংসদ জয়নাল আবেদীনও মুক্তিযোদ্ধা। তবে সাংসদ কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বা দেশের কোন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তা তিনি জানেন না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধ আমজাদ হোসেন বলেন, এলাকার উন্নয়নের দিকে তাঁদের সাংসদের কোনো নজর নেই। তিনি তাঁর নিজের মঙ্গল করে চলেছেন। দলের চেয়ে তাঁর স্বজনরাই ঘনিষ্ঠ এবং তিনি তাদের নিয়েই ওঠাবসা করেন। এলাকাবাসী এই সাংসদকে পেয়ে হতাশ বলেও তিনি আক্ষেপের সঙ্গে জানান।
মেহেরপুর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, তৎকালীন মহুকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ভাষাসৈনিক ও মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন বলেন, 'আমাদের সাংসদ মূলত একজন ব্যবসায়ী। রাজনীতির চেয়ে ব্যবসাই তাঁর কাছে মুখ্য। ফলে যেখানে লাভ আছে, তিনি সেখানেই থাকেন। রাজনীতিটাকেও তিনি ব্যবসার পণ্য হিসেবে দেখেন। ফলে তাঁর কাছ থেকে রাজনৈতিক প্রত্যাশা পূরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাঁর এই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড আর স্বজনপ্রীতি মেহেরপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং এর ফলে দলের আদর্শগত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।' জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষযক সম্পাদক আবদুল মান্নান জানান, সাংসদ জয়নাল আবেদীনের এই সব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে গত ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানিয়েছেন। এ ছাড়া দলীয় বিভিন্ন মিটিংয়েও বিষয়টি কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেলসহ আরো বেশ কয়েকজনকে জানিয়েছেন। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, দেখবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি বা কেন্দ্র থেকে কেউ এগিয়েও আসেননি। সাংসদ জয়নালের এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং আত্মীয়করণ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে তিনি জানান।
আমঝুপির আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার খলিলুর রহমান বলেন, মেহেরপুরের এমন অবস্থা যে জয়নাল আবেদীনের নিজের লোকজন ছাড়া কেউ ঠিকাদারি করতে পারবে না। করতে হলেও বড় একটা টাকা দিতে হবে ওদের। আর সে কারণেই দুটি দরপত্র কেনার অপরাধে খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। জয়নাল আবেদীনের পোষ্য ক্যাডার বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন তিনি। তিনি গ্রামপুলিশের পোশাক সরবরাহ আর মেয়াদোত্তীর্ণ একটি শষ্যবীজ (মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তেল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়) কেনার দরপত্র কিনেছিলেন। কেনার আগে তাঁকে কেউ বাধা দেয়নি বা নিষেধ করেনি। কিন্তু এই খবর জয়নাল আবেদীন আর ইয়ারুলের লোকজন জানতে পেরে তাঁকে বাসা থেকে ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে নিয়ে মারধর করে। এ সময় তিনি পানি খেতে চাইলে তাঁর মুখে ও শরীরে প্রসাব করে দেয় জয়নালের ক্যাডাররা। মারধরের সময় তিনি যখন চিৎকার করছিলেন, তখন মোবাইল ফোনে তাঁর সেই আর্তনাদ সাংসদ জয়নাল আবেদীন ও তাঁর সহযোগী ইয়ারুলকে শোনানো হয় বলে তিনি জানান।
মেহেরপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রোমানা আহম্মেদ এবং আবদুল মালেক (স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা) জানান, সাংসদের কাছ থেকে তাঁরা এলাকার উন্নয়নে কোনো প্রকার সহযোগিতা পাচ্ছেন না। বরং ঘটছে সব উল্টো। তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাণ্ডার থেকে মেহেরপুরের অসহায় মহিলাদের মধ্যে বিতরণের জন্য শাড়ি আসে। সাংসদ তাঁদের কোনো কিছু না জানিয়ে তাঁর নিজস্ব বাহিনী নিয়ে নিজেদের পরিচিতজনদের মধ্যে এই শাড়ি বিতরণের উদ্যোগ নেন। এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে তাঁরা হাজির হয়ে সাংসদের কাছে জানতে চাইলে সাংসদ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এ সময় সাংসদের নির্দেশে তাঁর সঙ্গে থাকা সন্ত্রাসীরা তাঁদের দুজনকেই মারধর করে। এমনকি রোমানা আহম্মেদের পরণের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে তাঁকে প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। ভাঙচুর করা হয় উপজেলা পরিষদ।
রোমানা জানান, সাংসদ তাঁকে শুধু মারধরই নয়, দোতলা থেকে ফেলে দেওয়ারও নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে তিনি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। সাংসদ তাঁকে এখন হুমকি দিচ্ছেন থানা থেকে অভিযোগটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য।

No comments

Powered by Blogger.