অতিথি-শিশুটিকে শুনুন ও বুঝুন: ড. আনুলা নিকাপোতা by তানজিনা হোসেন

শিশুদের মানসিক সংকটগুলো বিশ্বজুড়ে কম-বেশি একই রকম। পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে, প্রতি দেশে, প্রতি সংস্কৃতিতে শিশু-কিশোরেরা প্রায় একই রকম অসহায়ত্ব, একই ধরনের একাকিত্ব এবং একই রকম সংকটে ভোগে। কালো আর সাদা, ধনী কিংবা গরিব, গ্রাম ও শহরের শিশুতে কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীর চলমান সংকট, রাজনীতি, সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও অসাম্য তাদের একইভাবে আক্রান্ত করে। তাহলে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের শিশু-কিশোরদের পার্থক্য কোথায়?


পার্থক্য হলো সেবাদানের জায়গাটাতে। বলছিলেন শিশু-কিশোর মনোরোগবিদ ড. আনুলা নিকাপোতা। ইংল্যান্ডের মডসলে এনএইচএস ট্রাস্টের শিশু-কিশোর মনোরোগ বিষয়ের ইমেরিটাস উপদেষ্টা আনুলার আদিবাস শ্রীলঙ্কায়। পাঞ্জাবি বাবা ও শ্রীলঙ্কান মায়ের মিশ্র সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা সত্তরোর্ধ্ব এই নারী বর্তমান বিশ্বে শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব বিষয়ে বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ একজন বিশেষজ্ঞ। প্রায় ৪০ বছর ধরে শিশু-কিশোরদের মানসিক সংকট ও সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন তিনি। কাজ করেছেন ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিশু-কিশোরদের মানসিক সেবার মান বাড়াতে। যুক্তরাজ্যে এই বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ কোর্সের তিনি প্রোগ্রাম লিডার। স্থায়ী বাস লন্ডনে হলেও শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব নিয়ে মনোচিকিৎসক, মনোবিদ, মনোসেবী এবং নীতিনির্ধারকদের উপদেশ-প্রশিক্ষণ দিতে এ বয়সেও ছুটে চলেছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সে কারণেই সম্প্রতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট মেন্টাল হেলথের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। এখানে তিনি স্থানীয় মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসকদের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেন এবং বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। তিন দিনের ঝটিকা সফরের ফাঁকে এক সন্ধ্যায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আলাপে প্রথম প্রসঙ্গটিই ওঠে উন্নত বিশ্বে, যেখানে তিনি কাজ করেন, সেখানকার শিশু-কিশোরদের সঙ্গে আমাদের শিশু-কিশোরদের মানসিক সংকটের পার্থক্য নিয়ে। আর সে প্রসঙ্গেই তিনি বলেন, পার্থক্যটি মূলত সেবাদান বা সার্ভিসের ক্ষেত্রে প্রকট, নয়তো দুনিয়াজুড়ে সব শিশুরই সমস্যা মোটামুটি এক। দ্রুত পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব, ভঙ্গুর পারিবারিক মূল্যবোধ, মন্দ অর্থনীতির প্রভাবের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস, যুদ্ধ, মাদক, নেশা, শিশুশ্রম; যা ক্রমেই বিশ্বের শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু উন্নতমানের সেবা না থাকার জন্যই উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল বিশ্বের শিশুরা অধিকতর অসহায় হয়ে পড়ে। ধরা যাক, শারীরিক শাস্তির ব্যাপারটাই। এই সমস্যা ওসব দেশেও কম-বেশি আছে। কিন্তু সেখানকার শিশুদের সাহায্য করার জন্য একটা বিশেষ চাইল্ড লাইন আছে টেলিফোনের, শিশুকে নিরাপদ রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদা প্রস্তুত থাকে। চাইল্ড অ্যাবিউস, ইভ টিজিং, যৌন নির্যাতন ওখানেও কম হয় না। কিন্তু আক্রান্ত শিশুটি বা কিশোরীটি গলায় দড়ি দেওয়ার বদলে যেকোনোভাবেই হোক আইনের বা সরকারের সাহায্য পেতে পারে। ইংল্যান্ডে একটা আইনই আছে, কোনো শিশু যদি কারও কাছে—সে শিক্ষক হোক, পথচারী হোক, প্রতিবেশী হোক—কোনো অভিযোগ করে বা সাহায্য প্রার্থনা করে, সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ তা কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ্য থাকবে। নইলে তার নামে মামলা হয়ে যাবে।
ড. আনুলা আশির দশকের শুরুতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তাঁর নিজের দেশে, শ্রীলঙ্কায়। সে দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় শিশু-কিশোরদের মানসিক সেবা দেওয়ার জাতীয় কর্মসূচিটি তিনিই প্রথম যুক্ত করেন। শ্রীলঙ্কা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে একটি বিশেষ চাইল্ড প্রটেকশন প্ল্যান গৃহীত হয়েছে, যা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এসব ক্ষেত্রে ড. আনুলা বলেন, শিক্ষার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে সাহায্য করে। কেবল পরিবার, অভিভাবক, শিক্ষক এবং সাধারণ জনগণের জন্য নয়, নিজেকে নিরাপদ রাখার শিক্ষা শিশু বা কিশোরীটিকেও দিতে হবে। নিজের অধিকারগুলো জানতে হবে তাকে। যেমন, বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে শিশুশ্রমের মতো বিষয় চাইলেই উঠিয়ে দেওয়া যায় না। এখানে একটি দরিদ্র পরিবারের সবাই রোজগারে ব্যস্ত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু যাঁরা শিশুদের কাজে লাগাবেন, তাঁদের জানতে হবে যে এই শিশুটিরও অধিকার আছে শিক্ষার, সঠিক পুষ্টি ও বিনোদন-খেলাধুলার। কাজের পরিবেশে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবার সেই শিশুশ্রমিক ও তার পরিবারও জানবে যে এই সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে মালিক আইনগতভাবে বাধ্য, এ নিয়ে তখন তারা দেনদরবার করতে পারবে। সব পক্ষ শিক্ষিত ও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকলে সব আইনই শেষ পর্যন্ত কাগুজে হয়ে পড়ে। আবার মাদকের কথাই ধরা যাক, নেশার বিস্তার ও সহজলভ্যতা ঠেকানো সরকারের কাজ, কিন্তু পরিবারের কাজ হচ্ছে সন্তানকে মানসিকভাবে পরিণত ও শক্ত করে তোলা, নেশার ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করতে শেখানো, না বলতে শেখানো, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করার সাহস জোগানো। একই কথা আত্মহত্যাপ্রবণ শিশুদের বেলায়ও প্রযোজ্য, যা এখন বিশ্বে এক বড় মানসিক সমস্যা। নিজেকে হনন করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব বা সমাধান নেই, এই বিশ্বাস যার মধ্যে থাকে, সে আত্মহত্যা করবে না। যে তার চারপাশ থেকে জীবনের পক্ষে প্রচুর ইতিবাচক কথা শুনবে, সে-ও তা করবে না। এই যে মানসিক ভিত, তা একদিনে গড়ে ওঠে না। এটাকে বলে প্রবলেম সলভিং অ্যাটিচিউড বা সমস্যা উত্তরণের ক্ষমতা। এটা শিশু-কিশোরদের মধ্যে গড়ে তুলতে হয়, আর এই গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা প্রথমে পরিবারের, তারপর শিক্ষক ও বন্ধুবান্ধবের, তারপর সমাজ ও গণমাধ্যমের। তাহলে চারদিকের এসব সর্বনাশা জিনিস—নেশা, ডিপ্রেশন, আত্মহত্যা, মন্দ সঙ্গ, পর্নো, অ্যাবিউস, যৌন ও মানসিক নির্যাতন, বুলিং ও টিজিং—মোকাবিলা করা কীভাবে সম্ভব? ড. আনুলার মতে, প্রথম কথা হচ্ছে সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষা। সবার জন্য শিক্ষা, পরিবেশ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এ ছাড়া গুড প্যারেনটিং বা ভালো অভিভাবকত্ব। তার জন্য মা-বাবাদের বলব—শুনুন, বুঝুন আপনার শিশুটিকে। প্রয়োজনে বারবার শুনুন। ধারাবাহিকভাবে শুনুন। ধৈর্য ধরে ও ইতিবাচক ভঙ্গিতে শুনুন। লিসেনিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। দেখুন ও সচেতন থাকুন সন্তানের কর্মপরিধি সম্পর্কে। ভালো ও মন্দ তাকে বুঝতে শেখান। ভালো ও মন্দ উভয় সময়েই তার সঙ্গে থাকুন। দয়া করে কখনো তাকে দূরে ঠেলে দেবেন না।

No comments

Powered by Blogger.