প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সংশয়

দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরে অর্জিত হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার খুবই কম। এক দশক ধরেই দেশে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৪ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ কোনো দেশ যখন তার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ কিংবা ৮ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা করে, তখন বিনিয়োগের এই চিত্র মোটেও সুখকর


নয়।’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এখন ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে, বিশেষত মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ঊর্ধ্বমুখী, সেখানে এটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।’
মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ওপরে থাকা যেকোনো অর্থনীতির জন্য অস্বস্তিকর বলেও মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।
গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে দক্ষিণ এশিয়া নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সানি) ১১তম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সম্মেলনের আয়োজন করে সানি এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেক সময় বিশ্বমন্দা সরকারের নীতিকে সমস্যায় ফেলে দেয়, যেমনটা এ বছর ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি দেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে সরকারকে ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। এটি আবার মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এটি সরকারকে বাজেট ঘাটতি বাড়ানোর আশঙ্কায়ও ফেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এ বছর বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা করেছিলাম। ভর্তুকি বাড়ার কারণে বাজেট ঘাটতি এর মধ্যে সীমিত রাখা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
দুটি কারণে সরকারকে বাজেট ঘাটতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে দেরিতে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের ভর্তুকি বেড়েছে। তা ছাড়া এ বছর যত বিদেশি সহায়তা পাওয়ার কথা ছিল, তার প্রায় সবই এসেছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে না।
দেশে সরকারি ব্যয় খুবই কম উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘নেপালের সরকারি ব্যয়ও আমাদের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় কখনোই ১৫ শতাংশের বেশি হয়নি। ৪০ বছর ধরে এই ব্যয় ৭ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে ছিল।’ সরকারি ব্যয় বাড়ানোর দুটি উপায় চিহ্নিত করেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর মতে, বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের পরিমাণ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারলে সরকারি ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হবে।
বেশি দামে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মিডিয়াগুলোতে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমালোচনা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরাও একই কথা বলছেন। কিন্তু আমি এই বিষয়ে চিন্তিত নই। কারণ, বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ার কারণেই গত বছর দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪১ শতাংশ।’
বিশ্বের সাম্প্রতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত দুই বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের দুটি নীতিগত কৌশলের কারণে এটি হয়েছে। এগুলো হলো: দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং দ্রুত কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন খাতগুলোর ওপর জোর দেওয়া।
নিত্যপণ্যের দাম যে সারা বছর লাগামহীন ছিল, তা স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম আমাদের হতাশ করেছে। সারা বছর ধরেই এটা বেড়েছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, জনকল্যাণে সরকার কৃষি, খাদ্য বিতরণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি দিচ্ছে। তেলের ক্ষেত্রে ভর্তুকির প্রতি নজর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতির কারণে তা করা যায়নি। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার তিনি বলেন, ‘আমরাও এ ক্ষেত্রে আংশিকভাবে দায়ী। কারণ, আমরা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।’
বাংলাদেশে আদমশুমারি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের জনসংখ্যা ঠিকমতো নির্ণয় করা না গেলে উন্নয়নকাজও ঠিকমতো করা যায় না। কেউ বলছে, দেশের জনসংখ্যা এখন ১৫ কোটি। আবার কেউ বলছে ১৬ কোটি। এ কারণে খাদ্য বাজেট তৈরির ক্ষেত্রেও মারাত্মক সমস্যা হয়।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করতে গিয়ে সানির গবেষণা প্যানেলের চেয়ারম্যান ও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক টি এন শ্রীনিভাসম বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া নতুন কিছু নয়। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভর্তুকি যাদের জন্য দেওয়া হচ্ছে, তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এটা একটা বড় সমস্যা।
শ্রীনিভাসম আরও বলেন, গত বছর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এখন যেসব সংকট চলছে, তার পরিণাম কী হবে, সেটার পথ নিয়ে চিন্তা করা। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি একজোট হতে না পারে এবং ইউরো-সংকট যদি না কাটে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব হবে ভয়াবহ।
অনুষ্ঠানে সানির সমন্বয়ক ও বিআইডিএসের মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি এবং গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক রামোনা মার্গারেটা নাকভি বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.