জিতেছে জনতা হেরেছে রাজনীতি

দ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যত রকম রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ কষেছে, তার সবই ফেল মেরেছে; মাঝখান দিয়ে পাস করেছে জনতার গণরায়। রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা তাই এখন বলছেন, নারায়ণগঞ্জে আসলে জিতেছে জনতা আর হেরেছে রাজনীতি। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি আর বিদ্রোহী প্রার্থীর বিপুল বিজয় অন্তত সেটাই প্রমাণ করে।


শুধু তাই নয়, রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকেই একটি স্পষ্ট শিক্ষা-বার্তা পেঁৗছে দিয়েছে যে, যত রাজনীতিই করা হোক, যত মারপ্যাঁচই কষা হোক-জনগণই সব ক্ষমতার উৎস; জনতার রায়ই চূড়ান্ত রায়। জনগণ সব সময় ভালোর সঙ্গেই থাকতে চায়। এর ভিত্তিতেই সব দলের ঠিক করা উচিত আগামী দিনের রাজনৈতিক কৌশল।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবিকে অনেকে মনে করছেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয়। তবে নির্বাচনে হেরে আওয়ামী লীগ এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের দোহাই দিয়ে এটাকে গণতন্ত্র ও জনগণের বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অবজ্ঞা করে সংবিধান লঙ্ঘন করলেও এখন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৃতিত্ব দাবি করছে। এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ জিতেছে। এটা সরকারের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দল কাউকে মনোনয়ন দিতে পারে না-মন্তব্য করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা শামীম ওসমানের পক্ষে প্রচারণায় গেলেও সবাই তাঁকে সমর্থন দেননি।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ওবায়দুল কাদের নারায়ণগঞ্জে জনগণের রায় মেনে নিতে হবে_মন্তব্য করে কালের কণ্ঠকে বলেন, এই নির্বাচনে গণতন্ত্র ও জনগণের বিজয় হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করাটা সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল এবং সরকার সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করছেন, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি যে মাগুরা নির্বাচন কাহিনীর প্লট তৈরি করতে চেয়েছিল, তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আবার বিএনপি নেতাদের মতে, বিএনপি হয়তো এই নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে জিতত। কিন্তু দলের প্রধান যে দাবি_তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, সে ক্ষেত্রে এই নির্বাচনে অংশ নিলে পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন উঠতে পারত, তাহলে কেন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে অংশ নিল বিএনপি?
তবে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সরকার একটা সংকেত পেয়েছে এবং দলটি পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দলের নেতারা। কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, জনগণই যে সকল ক্ষমতার মালিক, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ জনগণকে অবজ্ঞা করার ফল পেয়েছে। তারা পরিস্থিতি বুঝতে অসমর্থ হয়েছে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ একটা সতর্ক সংকেত দিয়েছে মন্তব্য করে মেনন বলেন, এ সংকেত আওয়ামী লীগ বুঝতে পারবে কি না, সেটা তাদের ব্যাপার।
রাশেদ খান মেনন গতকাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সরকারের একটা বড় শিক্ষা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ যাঁকে পছন্দ করতেন, তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে একজন সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সে সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, এখন তারা বুঝতে পারছে। এ ভুল থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুও মনে করেন, প্রার্থী সমর্থনে আওয়ামী লীগ জনগণের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের জনগণ আওয়ামী লীগকে একটা বার্তা পাঠিয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা গায়ের জোরে ভোট নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সরকার ও আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা হেরেছেন মন্তব্য করে ইনু আরো বলেন, বিএনপিও এই ভোট নিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদেরও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। এ নির্বাচনে আসলে ভালো প্রার্থী, ভোটার ও নির্বাচন কমিশনের জয় হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শুরু থেকেই আলোচনা ছিল, বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন না। কেন্দ্র থেকেও প্রার্থীকে বিজয়ী করার ব্যাপারে তাদের তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। এ থেকেই অনেকে ধারণা করছিলেন, শেষ মুহূর্তে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন। নির্বাচনে না থেকে এটাকে পুঁজি করে ভবিষ্যতে আন্দোলন করবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবিকেও তারা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। বিএনপি মনে করছে, এই নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। কারণ, তাদের প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূরের জয়ী হওয়ার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে মাঠ জরিপ করেও তারা এ আলামত পেয়েছে। তার পরও নির্বাচনে থাকলে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত। এই দায় বিএনপির ওপর বর্তিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর মামলা-মোকদ্দমা হতো। বরং নির্বাচনে না থেকে এখন তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টি জোরেশোরে প্রচার করতে পারবে। এর ফল ভবিষ্যতে পাবে বিএনপি। এসব বিষয় ভেবেই নির্বাচন থেকে সরে এসেছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ার কালের কণ্ঠকে এ ব্যাপারে বলেন, 'নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন ও সরকারের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েন করার জন্য সরকারকে চিঠি দিলেও সরকার সেটা না করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। আবার সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে নির্বাচন কমিশনারও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।' তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারের পদত্যাগ করা উচিত বলে মন্তব্য করে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সম্ভব নয় এবং বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যে যৌক্তিক, তা প্রমাণ হলো।'
নির্বাচন থেকে বিএনপির সরে আসার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে এম কে আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপির বর্তমান দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন নয়। এই নির্বাচনে হয়তো বিএনপি জিতত; কিন্তু পরে প্রশ্ন উঠত, দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচন করবে না, কিন্তু নারায়ণগঞ্জে করল কেন। তবে নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সরে দাঁড়ালেও বিএনপির অনেক ভোটার আইভীকে ভোট দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি শামীম ওসমান এবং আইভীর মধ্যে লড়াইকে শান্তির সঙ্গে সন্ত্রাসের লড়াই বলে আখ্যায়িত করেন এবং আইভীকে শান্তির প্রতীক বলে আখ্যায়িত করেন।
নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শামীম ওসমান বিজয়ী হলে এখানে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি করা অনেকটাই কঠিন হয়ে যেত। তৈমূর মাঠ ছেড়ে দেওয়ায় তাঁর অনেক ভোটই আইভী পেয়েছেন। আইভী জয়ী হওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের নারায়ণগঞ্জে টিকে থাকা অনেকটাই সহজ হয়েছে। এ ছাড়া তৈমূরের সঙ্গে আইভীর বাবা আলী আহম্মেদ চুনকারও সুসম্পর্ক ছিল। আইভীও সেটা ধরে রাখতে পেরেছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে জানা গেছে, তৈমূর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন জেনেই তারা আইভী ও শামীম ওসমানকে নির্বাচনী মাঠে রেখে দেয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আরো জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান মনে করছেন, শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে বিষয়টি গোটা নির্বাচনকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারত। তিনি বলেন, 'সাংবিধানিক ক্ষমতাবলেই নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন চেয়েছিল। কিন্তু সরকার সে ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া না দিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করেছে। কোনো নির্বাচনে কমিশন সেনাবাহিনী চাইলে সরকার যদি তা না দেয়, বিরোধী দল যদি সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলে তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।'
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিজয়কে ইতিবাচক চোখে দেখছেন আকবর আলি খান। তিনি বলেন, 'এই বিজয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শুভ সূচনা বলে আমি মনে করি। এই নির্বাচন থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি বিষয়ে ভালোভাবে শিক্ষা নিতে হবে। আর সেটি হচ্ছে, তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া। এ নির্বাচনে তৃণমূল নেতৃত্ব জয়যুক্ত হয়েছে। আর পরাজয় হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।'
এ প্রসঙ্গে তিনি বিডিনিউজকে আরো বলেন, 'আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিল, নারায়ণগঞ্জের তৃণমূলের মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। এ থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আরো একটি শিক্ষা নিতে হবে। তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে হবে। আর এ কাজটি যদি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনুসরণ করে তাহলেই আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।'

No comments

Powered by Blogger.